কর্ণাটকের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিন বন্ধু। এইভাবেই একদিন চলে এলেন মেলকোটের যোগ নরসিংহের মন্দিরে। দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য মন্দিরগুলির মতোই প্রাচীন শিল্পরীতির ছোঁয়া এখানে। হঠাৎই মন্দিরের মেঝেতে এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ ওই তিনজনের একজন। ত্রিভুজাকার ওই নকশার ব্যাপারে তিনি কোথাও যেন পড়েছিলেন। ইতিহাসের ছাত্র হওয়ার দরুন মনে পড়তে বেশি সময় লাগল না। তবে আরও আশ্চর্য হলেন যখন দেখলেন, গোটা মন্দির প্রাঙ্গণে এরকম আরও বেশ কিছু নকশা আঁকা রয়েছে। প্রতিটাই অত্যন্ত প্রাচীন। গুপ্তধনের সংকেত নয়; বরং প্রত্যেকটাই একেকটা খেলার ‘বোর্ড’! আর প্রথমে দেখা ত্রিভুজাকার নকশাটি হল আদু হুলি, দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রাচীন একটি খেলা।
আসল ব্যাপারে আসার আগে ইতিহাসের স্বার্থেই একটু পাদপূরণ দরকার। প্রাচীন ভারতে ক্রিকেট বা ফুটবলের কোনো বালাই ছিল না। তাই বলে খেলারও কোনো কমতি ছিল না। নিজেদের মতো করে তৈরি হয়েছিল অনেক রকম খেলা। তার অনেকটাই আজ হারিয়ে গেছে; হাতে গোনা কিছু রয়ে গেছে। কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, বাকি সব আঞ্চলিক তকমা পেয়ে টিমটিম করে জ্বলছে। যাই হোক, প্রাচীন ভারতে অঞ্চলভেদেও নানারকম খেলা তৈরি হত। বাংলা, পাঞ্জাব, মারাঠা, দাক্ষিণাত্য— সব জায়গায় বৈচিত্র্য ছিল প্রকট। কখনও একই খেলা নাম বদলে অন্য রূপ পেয়ে যেত।
আদু হুলি সেরকমই একটি প্রাচীন খেলা। মূলত দক্ষিণ ভারত জুড়ে খেলা হলেও উত্তর ভারতের বেশ কিছু জায়গাতেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শুধু মন্দিরেই নয়; রাস্তার ধারে, ঘাটে, ধর্মশালায়, পুরনো বাড়ির ভেতর মেঝেতে নানা জায়গায় খেলা হত। এই বোর্ড গেমের চরিত্র বা খেলোয়াড় বলতে ছিল দুজন। একদিকে ছিল ভেড়া বা ছাগল (১৫টি), অন্যদিকে ছিল বাঘ (৩টি)। নিয়ম একটাই— ছকের বাইরে বেরনো যাবে না। তার মধ্যে থেকে বাঘের হাত থেকে তিনটে বাঘের হাত থেকে ছাগল বা ভেড়াদের বাঁচাতে হবে। পুরোটাই ছিল বুদ্ধির খেলা; আর সেইজন্যই এটি এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ এই খেলা শেখায় যতই দুর্বল হও না কেন, বুদ্ধির জোরে প্রবল শক্তিশালী প্রতিপক্ষকেও হারানো যায়। সেজন্য তখনকার দিনের রাজা-রাজড়াদের মধ্যেও এই খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
আরও একটা প্রশ্ন মাথায় আসতেই পারে। মন্দির তো পবিত্র স্থান। তখন তো আরও কড়াকড়ি ছিল। সেখানে এত খেলার ছক তৈরি করা হয়েছিল কেন? শুধু তো আদু হুলি নয়, নবকানাকড়ি, ষোলো সিপাই, আলিগুলিমানের মতো খেলাও দেখা গিয়েছে। বেনারসের মতো জায়গাতেও আদু হুলি, দাস গুটির মতো খেলার ছকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, তখনকার দিনের মন্দিরগুলি প্রধানত শহর বা গ্রামের মাঝখানে তৈরি হত। ফলে উপাসনার সময় সবাই সেখানে হাজির থাকত। সেই কাজ ছাড়াও গান-নাচ, বিদ্যাশিক্ষা, বিচারসভারও আয়োজন বসত মন্দিরে। এক কথায় বলতে গেলে সেটাই ছিল প্রাণকেন্দ্র। ফলে অবসর সময় খেলা বা বিনোদনের জন্য মন্দিরের মধ্যেই এইসব খেলার ছক তাঁরা খোদাই করে রেখেছিল বলে মত ঐতিহাসিকদের।
এই ধরণের খেলা ভারত থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছে। এখন অনেকে নামই ভুলে গেছেন। ঐতিহাসিকরা ধীরে ধীরে কবর খুঁড়ে তুলে আনছেন সেই সব দিনের কথা। পুরনো খেলা, তার রীতি, তার স্থানের ডকুমেন্টেশনই শুধু নয়; তাকে কি করে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টাও করা হচ্ছে। পঞ্চ কেলিয়া, আদু হুলির মতো জনপ্রিয় প্রাচীন খেলাগুলি এখনও সামান্য কিছু মানুষ খেলতে জানেন। সমস্ত হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন খেলা, যা মন্দির প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছিল, যা রাজা-প্রজা-পুরোহিতদের প্রভেদ মুছে দিয়েছিল; সেইসব অন্তত যাতে বেঁচে থাকে তারই চেষ্টা করা হচ্ছে। তৈরি করা হয়েছে বিশেষ ওয়েবসাইটও, যেখান থেকে এই খেলাগুলো সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়। যে কেউ গিয়ে শিখেও নিতে পারে। এভাবেই একটু একটু করে একটা বদল তৈরি হচ্ছে দেশে। জেগে উঠছে একটা ইতিহাস। জেগে উঠছে একটা হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
অজানা দুর্গের হদিশ নেদারল্যান্ডে, জানা যাবে ডাচদের প্রাচীন ইতিহাস?