উনিশ শতকের শুরুর দিক সেটা। ছোটোলাটের আসনে তখন লর্ড ওয়েলেসলি (Lord Wellesley)। ঘিঞ্জি কলকাতা থেকে সামান্য ফুরসৎ পেতে কলকাতা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ব্যারাকপুরে গভর্মমেন্ট হাউস তৈরির উদ্যোগ নিলেন তিনি। সপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর জন্য হুগলি নদীর তীরে নির্জন এই জায়গার থেকে ভালো বিকল্প আর কী-ই বা হতে পারে। তবে সেই কাজ শেষ করে যেতে পারেননি তিনি। ১৮২৩ সালে হেস্টিংসের আমলে শেষ হয় সেই ভবনের নির্মাণ। গভর্নর জেনারেল তো বটেই ছোটো-খাটো ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সম্মানীয় অতিথি-অভ্যাগত এবং পরবর্তীতে ভাইসরয়েদেরও সপ্তাহান্তিক আস্তানা হয়ে উঠেছিল ব্যারাকপুরের এই গভর্নর হাউস।
২০১৩ সালেই ঐতিহাসিক এই ভবনটিকে হেরিটেজের তকমা দিয়েছিল রাজ্য সরকার। এবার ঐতিহ্যবাহী ভবন হিসাবে তার সদরে বসল ব্লু প্লেক (Blue Plaque)। ‘গভর্নমেন্ট হাউস’-এর দরজা খুলে দেওয়া হল পর্যটকদের জন্যও।
তবে ব্যারাকপুরের এই গভর্নর জেনারেল হাউস (Governor General House) বা গভর্নমেন্ট হাউসের জন্মবৃত্তান্তের ইতিহাস আরও প্রাচীন। বলতে গেলে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ওয়েলেসলিরও আগে। সেটা ১৭৭৫ সাল। বাংলার নবাব সিরাজকে হারিয়ে একচেটিয়া ক্ষমতাবিস্তার করেছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেইসময়েই কলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যারাকপুরে সেনা ছাউনি গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশরা। আর সেই ক্যান্টনমেন্টের জন্যই বেছে নেওয়া হয়েছিল হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলটিকে। পরবর্তীকালে জায়গা পরিবর্তন হয় সংশ্লিষ্ট সেনা ছাউনিটির। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটির খানিক দক্ষিণে গড়ে ওঠে ব্যারাক। অন্যদিকে পূর্ববর্তী অঞ্চলটিতে গভর্নমেন্ট হাউস তৈরির উদ্যোগ নেন লর্ড ওয়েলেসলি। পরবর্তীতে লর্ড হেস্টিংস থেকে শুরু করে মিন্টো— ব্রিটিশ ভারতের প্রায় সমস্ত গভর্নর জেনারেলই কম-বেশি ছুটি কাটিয়েছেন এই সাহেবি ‘রাজপ্রাসাদ’-এ। আকবরের নির্মিত আগ্রা ফোর্ট থেকে আস্ত ফোয়ারা তুলে এনে এই ভবনকে সাজিয়েছিলেন লর্ড হেস্টিংস। তাছাড়াও লেডি ক্যানিং-এর অত্যন্ত প্রিয় জায়গা ছিল ব্যারাকপুরের এই গভর্নর হাউস। দীর্ঘদিন এই প্রাসাদে থাকা তো বটেই, কলকাতায় মারা যাওয়ার পর তাঁর ইচ্ছেতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল ব্যারাকপুরে।
পরবর্তীকালে শিমলা এবং দার্জিলিং জনপ্রিয় হয়ে ওঠায়, ব্যারাকপুরের এই ভবনটি গুরুত্ব হারায় বেশ খানিকটা। তবে কোনোদিনই অতিথিশূন্য হয়নি গভর্নমেন্ট হাউস। স্বাধীনতার পর ৩০০ একর জমির ওপর তৈরি প্রাসাদসম এই ভবনটি হাতে আসে রাজ্য সরকারের। কিছুদিন পরিত্যক্ত থাকার পর তা ব্যবহৃত হত পুলিশ হাসপাতাল হিসাবে। সেসময়ই গভর্নমেন্ট হাউস থেকে সরিয়ে ফেলা হয় ব্রিটিশ সাহেবদের পাথর ও ব্রোঞ্জ-নির্মিত বিভিন্ন মূর্তি। তাদের জায়গা হয় কলকাতার মনুমেন্ট এবং পার্কে। কেবলমাত্র ফ্ল্যাগস্টাফ হাউস এবং লর্ড মিন্টোর তৈরি একটি স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষিত হয়েছিল রাজ্যপালের জন্য।
আরও পড়ুন
বিলুপ্তির পথে কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী পাপিয়ার-মাশে শিল্প
বলতে গেলে দীর্ঘ ছ’দশকের পরিচর্যার অভাবে ধুঁকছিল ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপত্য। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে ইতিহাস সংরক্ষণে ব্রতী হয় রাজ্য সরকার। সংরক্ষণবিদ ও বিশিষ্ট স্থপতি মনিষ চক্রবর্তীকে দেওয়া হয় ইতিহাস পুনরুদ্ধার এবং ভবনটিকে নতুন করে সারিয়ে তোলার কাজ। ২০১৩ সালে ঐতিহ্যবাহী ভবনের তকমাও লাগে তার গায়ে।
আরও পড়ুন
ভারতের একমাত্র হাতে তৈরি শাটল কক উলুবেড়িয়ায়, ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী সেই শিল্পও
তবে এতকিছুর পরেও ব্যারাকপুর কিংবা কলকাতার বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিতই রয়ে গেছে ব্যারাকপুরের এই লাটভবন। সম্প্রতি, তার সাধারণের কাছে তার গুরুত্ব এবং বর্ণময় ইতিহাসকে তুলে ধরতেই পুনরায় ব্লু প্লেক স্থাপনের বন্দোবস্ত করে রাজ্য সরকার। ব্রিটিশ শাসকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, আগ্নেয়াস্ত্র এবং ছোটো-বড়ো স্মারকে সাজিয়ে তোলা হয় মিউজিয়ামও। ইতিহাস সংরক্ষণ তো বটেই, গভর্নমেন্ট হাউসের এই নতুন রূপদান আকৃষ্ট করবে দেশ-বিদেশের পর্যটকদেরও। আর্থ-সামাজিক চেহারা ফিরবে গোটা অঞ্চলটির। সে-ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী হেরিটেজ কমিশনের কর্মকর্তারা…
আরও পড়ুন
ঐতিহ্যবাহী টেস্ট পেপার, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষক-ঐক্য ও শতবর্ষের এবিটিএ
Powered by Froala Editor