“সপ্তাহ দেড়েক আগের ঘটনা। বাঘাযতীনে এক পেশেন্টের এসপিও২ লেভেল এতটাই কমে গিয়েছিল যে তৎক্ষণাৎ অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন। অক্সিজেন প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওঁরা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দাম হাঁকেন। শর্ত একটাই, একসঙ্গে দুটো সিলিন্ডার নিতে হবে। সংকটে পড়ে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে দুটো সিলিন্ডারই নিয়েছিলেন পেশেন্ট পার্টি। কিন্তু সিলিন্ডার বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই মারা যান রোগী। এদিকে বেমালুম বেপাত্তা অক্সিজেন প্রোভাইডার। দশ দিন পেরিয়ে গেছে ঘটনার, এখনও ওঁর ফোন সুইচড অফ।”
বলছিলেন কোভিড ভলেন্টিয়ার সৌত্রিক চক্রবর্তী। এই সংকটকালে স্বেচ্ছাতেই লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। কথায় কথায় উঠে এল, বিগত ১৮ দিনে প্রায় চার হাজার ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন সৌত্রিক এবং তাঁর সহকর্মীরা। কখনও পেশেন্ট পার্টিকে অক্সিজেন প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। আবার কখনও নিজে সংগ্রহ করে এনে দিয়েছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর মাঠে নেমে কাজ করতে গিয়েই একেবারে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, অক্সিজেন নিয়ে কী মাত্রায় চলছে কালোবাজারি।
রাজ্যে এখনও সমান গতিতেই বেড়ে চলেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। শয্যাশূন্য অধিকাংশ হাসপাতালই। ফলে রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। পরিস্থিতি জটিল হলেই দরকার পড়ছে অক্সিজেনের। একদিকে যেমন এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তরুণরা, বিপরীতে ঠিক একইভাবে অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। যদৃচ্ছ দাম চেয়ে বসা হচ্ছে রোগীদের থেকে। ৬০-৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখের অঙ্কও পেরিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম।
তবে টাকা দিয়েও যে অক্সিজেন মিলবে, সেই সম্ভাবনাও বেশ ক্ষীণ। অনেকক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, অনলাইনে অ্যাডভান্স টাকা পাঠালেই রোগীর বাড়িতেই পৌঁছে দেওয়া হবে অক্সিজেন। পেশেন্ট পার্টির বিশ্বাস অর্জন করতে, বাড়ির ঠিকানা-সহ অন্যান্য ডকুমেন্টের ফটোকপিও সংগ্রহ করছেন তাঁরা। কিন্তু আগাম অর্থ দেওয়ার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলেও, আসছে না অক্সিজেনের সিলিন্ডার। স্বেচ্ছাসেবক মণিদীপা শীল জানালেন, “আমার সঙ্গে এই ঘটনা না ঘটলেও, অত্যন্ত পরিচিত বন্ধুমহলেই ঘটেছে এমন ঘটনা। এই ঘটনার পর থেকে আমরা প্রত্যেককে বারণ করছি আগে পেমেন্ট করবেন না। কারণ, অক্সিজেন আছে কিনা সেটা জেনে আমরা লিড দিয়ে দিচ্ছি পেশেন্ট পার্টিকে। কিন্তু প্রোভাইডার কত টাকা নিচ্ছে বা কীভাবে টাকা নিচ্ছে, সেটা সবসময় জানা সম্ভব হচ্ছে না আমাদের পক্ষে।”
আরও পড়ুন
‘আইভারমেকটিন’ ম্যাজিক ড্রাগ নয়, ডেকে আনতে পারে বিপদও; জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
এই কালোবাজারির সঙ্গে শুধু কি ব্যবসায়ীরাই জড়িয়ে? উত্তর, না। বরং তাঁর সঙ্গে সাধারণ মানুষও এই বৃহত্তর জালিয়াতির সংশ। “অনেকক্ষেত্রে যে সমস্ত রোগীরা সেরে উঠেছেন কিংবা মারা গেছেন— তাঁরা অক্সিজেন আটকে করে রেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলা হচ্ছে, আমাদের তো চিকিৎসায় অনেকটা খরচ হয়েছে ফলে এটা আমরা বেশি দামে বিক্রি করব, যদি সেই খরচটা উঠে আসে। এটাও তো একটা কালোবাজারি”, বলছিলেন আরেক স্বেচ্ছাসেবক শুভেন্দু দেবনাথ।
আরও পড়ুন
কনসেন্ট্রেটর থেকে সিলিন্ডার – অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে তৈরি শহরের তরুণ প্রজন্ম
আবার কোথাও কোথাও মানুষ সংক্রমণের আশঙ্কায় আগে থেকেই বাড়িতে সঞ্চয় করে রেখেছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার। অথচ, বাড়িতে অসুস্থ রোগী নেই কোনো। এই ঘটনাও তো অক্সিজেনের ঘাটতিকে ঠেলে দিচ্ছে চরমে। কিন্তু সত্যিই কি অক্সিজেনের সরবরাহ একেবারেই হচ্ছে না রাজ্যে? দক্ষিণ কলকাতার পৃথক দুই অক্সিজেন রিফিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে জানা গেল, তাঁদের কাছে মজুত রয়েছে অক্সিজেন। না, কোনো আকাশছোঁয়া দাম নয়। স্বাভাবিক মূল্যেই পাওয়া যাবে পরিষেবা। তবে অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই তাঁদের কাছে। সেটা নিয়ে আসতে হবে পেশেন্ট পার্টিকেই। একই কথা জানালেন ডায়মন্ড হারবারের এক ব্যবসায়ীও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাটানগরের এক ওষুধ বিপণীর কর্মকর্তা তুলে ধরলেন আরও একটি সমস্যা, “এখন অনেকেই খোঁজ করছেন ফ্লোমিটার, অক্সিজেন মাস্কের জন্য। ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে তাঁদের। কারণ, বাড়তি মাস্ক, ফ্লোমিটার আমরাই পাচ্ছি না বাজারে। তবে সিলিন্ডার তৈরি হওয়ার সময়ই, সমান অনুপাতে এই সামগ্রীগুলো তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সংস্থারা। আসলে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই অভাব তৈরি করছেন কিছু মানুষ।” সেখান থেকে অনেকটাই পরিষ্কার যে, রাজ্যজুড়ে এই হাহাকার মূলত সিলিন্ডার ও অন্যান্য সামগ্রীর অভাবে। অনেক প্রোভাইডারই নিজের কাছে সঞ্চয় করে রাখছেন সিলিন্ডার। কেবলমাত্র পরিচিতদের মধ্যেই পরিষেবা দিচ্ছেন তাঁরা। তাছাড়া সুবিধা পাচ্ছেন সমাজের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এমনকি সিলিন্ডারের এই অভাবের জন্য কিছুক্ষেত্রে দায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলিও। সেটা কীভাবে?
আরও পড়ুন
মুমূর্ষু রোগীদের বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ, সংকটকালে ভরসা দিল্লির তরুণরাই
“যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনকে সম্প্রতি আমরির মতো একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হল। যাঁদের অক্সিজেন লেভেল ৯০-এর বেশি, তাঁদের অক্সিজেন দিচ্ছেন। তার জন্য চার্জ নেওয়া হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। প্রথমত, ৯০-এর বেশ স্যাচুরেশন লেভেল থাকলে সত্যিই কি দরকার পড়ে অক্সিজেনের? ক’জন মানুষ সেটা অ্যাফোর্ড করতে পারছে? তার থেকে সরকার যদি এই উদ্যোগ নিত, স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্য দরিদ্ররা এই পরিষেবা পেতেন। অন্যদিকে এখানে যে সিলিন্ডারগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে বা পড়ে আছে— সেগুলো খোলা বাজারে থাকলে এই হাহাকার খানিকটা হলেও কমত”, উত্তর দিলেন সৌত্রিক চক্রবর্তী।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এই জালিয়াতির পথ কি বন্ধ করা যাবে না কোনোভাবেই? প্রশাসনও কি নিষ্ক্রিয়? না, তেমনটা নয়। আসলে এই ঘটনা প্রমাণ করাই দুষ্কর হয়ে উঠেছে। এই ধরনের ব্যবসা অবৈধ হওয়ায়, ভুয়ো অক্সিজেন প্রোভাইডারদের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না কোনো লিখিত ডকুমেন্টই। অন্যদিকে প্রোভাইডারের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে অক্সিজেন না পাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। শুভেন্দু দেবনাথ জানালেন, “সে-জন্য অনেকক্ষেত্রে পুলিশকে দিয়ে ফোন করিয়েছি আমরা। প্রশাসনের ধমকে কাজ হয়েছে খানিকটা হলেও।” আবার কোথাও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ায় হুমকিরও সম্মুখীন হচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক এবং রোগীর পরিবার। ফলে আইনের দ্বারস্থ হতে পিছিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। স্বেচ্ছাসেবক স্বর্ণালী সেন জানালেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য ভুক্তভুগীদের থেকে লিখিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করেছিলাম। পোস্ট করেছিলাম সেটা আমার ফেসবুক প্রোফাইলে। তারপর থেকেই ক্রমাগত হুমকি আসতে থাকে ফোনে। বিষয় হল, যাঁরা এই কালোবাজারিটা করছেন, তাঁরা পরিকল্পনা করেই করছেন। টাকার লেনদেন হওয়ার পর থেকেই আর তাঁদের ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না।”
তবে ক্রমশ বাড়তে থাকা এই জালিয়াতির চক্রকে দমন করতে এবার নড়ে চড়ে বসেছে প্রশাসন। অক্সিজেন সিলিন্ডারের কালোবাজারি রুখতে আজই বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছেন লালবাজার। তার সঙ্গেই দেওয়া হয়েছে ক্রাইম ব্রাঞ্চের যুগ্ম পুলিশ অফিসারের মেল-আইডি। প্রতারণার খবর পাওয়ার পরেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেই আশ্বাস দিচ্ছেন তাঁরা। এর আগে প্রশাসনের এই তৎপরতায় কাজ হয়েছিল রেমডিসিভিরের ক্ষেত্রে। বন্ধ হয়েছিল কালোবাজারি। এবার দেখার, অক্সিজেনের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী হয় পুলিশের এই পদক্ষেপ…
Powered by Froala Editor