কলকাতা— আমাদের প্রাণের শহর। যার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে নস্টালজিয়া; রয়েছে ইতিহাস। কত না বলা গল্প তৈরি হয়েছে এই শহরে। শুধু মানুষই নয়, এখানকার রাস্তাগুলোও ছুঁয়ে রেখেছে নানা ছবি। এক একজনের এক একরকম ইতিহাস। চেনা অচেনা কত নাম জুড়ে আছে সেখানে। কিন্তু কোনো বইয়ের নামে রাস্তার কথা মাথায় এসেছে? কোনো মনীষী বা ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান নয়, স্রেফ একটি বই। হ্যাঁ, সাহিত্যের শহর কলকাতা দেখিয়েছে সেই অভূতপূর্ব নিদর্শনও।
এটুকু পড়ে ভাবতেই পারেন, কলেজ স্ট্রিট অর্থাৎ আমাদের চেনা বইপাড়ার কথা বলা হবে এবার। কলকাতা, সাহিত্য আর কলেজ স্ট্রিট এক সূত্রে গেঁথে আছে ঠিকই; কিন্তু এই কাহিনি সেখানকার নয়। বরং সেখান থেকে একটা বাস কিংবা ট্যাক্সি ধরে নিন। সোজা চলে আসুন বাগবাজার। সেখানকার কাঁটাপুকুর অঞ্চলে এলেই চোখে পড়বে একটি রাস্তার নাম। ‘বিশ্বকোষ লেন’। শুধু বাংলা কেন, গোটা ভারতের প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া হল এই গ্রন্থ। তার নামেই আস্ত একটা রাস্তা! এর ইতিহাস জানতে গেলে একটু পেছনে ফিরে তাকাতেই হবে। ওই রাস্তাতেই তো অবস্থিত নগেন্দ্রনাথ বসু’র। বিশ্বকোষের সঙ্গে যার নামটি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।
১৮৬৬ সালে জন্ম নগেন্দ্রনাথের। আদি বাড়ি ছিল মাহেশে। সেখান থেকে বাগবাজারে চলে আসেন নগেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা। আমৃত্যু এই বাড়িতেই থেকেছেন নগেন্দ্রনাথ। ছোটো থেকেই পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী। মূলত ইতিহাসচর্চাতেই মেতে থাকতেন তিনি। নিজের সময় অন্যতম প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে ছিল অপরিসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার। একটা সময় এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যও ছিলেন। সংগ্রহে ছিল অসংখ্য পুঁথি, পাণ্ডুলিপি। সেই সব নিয়েই ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার শুরু হয় বাংলা বিভাগ।
কিন্তু এই যে গোটা পৃথিবীতে এত সব আশ্চর্য জিনিস ছড়িয়ে আছে, কত বিষয়— সেগুলো বাংলার সাধারণ মানুষ জানবে না? এই ব্যাপারটাই ভাবাত তাঁকে। ইতিমধ্যেই বাংলা থেকে ইংরেজি অভিধান ‘শব্দেন্দু মহাকোষ’, ‘শব্দকল্পদ্রুম’ সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। অবশেষে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হল। ১৮৮৭ সালে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় ‘বিশ্বকোষ’। বাংলার প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া। শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতীয় ভাষার প্রথম এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরের বছরই বিশ্বকোষের দায়িত্ব চলে আসে নগেন্দ্রনাথ বসু’র হাতে। তারপর থেকে দীর্ঘ ২২ বছর বিশ্বকোষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অটুট। প্রায় ১৭ হাজার পৃষ্ঠার মোট ২২টি খণ্ড সংকলন করেন এই সময়। ১৯১১ সালে সেটা প্রকাশ পায়।
১৯৩৩-এ আবারও বিশ্বকোষের কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এবার আর বেশিদিন পারলেন না। মৃত্যু দাঁড়ি টেনে দিল তাঁর কাজে। ততদিনে তাঁর বাড়ির সামনের কাঁটাপুকুর বাই লেনের রাস্তার নামটিও বদলে গেছে। ১৯১৫ সালে কলকাতা কর্পোরেশন ওই রাস্তাটির নতুন নামকরণ করে ‘বিশ্বকোষ লেন’। আজ যেখানে রাস্তাটা দেখছেন, সেখানেই ছিল নগেন্দ্রনাথ বসু’র বাড়ি। এমন উদাহরণ সারা বিশ্বে আর একটিমাত্র আছে। ২০১৩ সালে, নেইল গেইম্যানের লেখা বইয়ের নামানুসারে ইংল্যান্ডের সাউথসী-র একটি অনামা রাস্তার নামকরণ করা হয় ‘দ্য ওশান অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য লেন’। তবে সারা বিশ্বে ‘প্রথম’ হিসেবে উঠে আসবে কলকাতার এই ঠিকানাই।
Powered by Froala Editor