পাঁচ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে একটি দেশ। তার বদলে দুই ভাগ হয়ে যেতে হয়েছে তাকে। ভারতের পাশেই জন্ম নিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫২ সালে সেখানেই জ্বলে উঠল আগুন। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য ঢাকার রাস্তায় নেমে এল মিছিল। পুলিশের গুলিতে সেখানেই মারা গেলেন কয়েকজন তরুণ। তৈরি হল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। গোটা বিশ্ব স্বীকৃতি দিল বাংলা ভাষার এমন লড়াইকে। প্রায় একই সময় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আরও একটি আন্দোলন জমাট বাঁধছিল। আর সীমানা পেরিয়ে নয়; এবার ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল পুরুলিয়ায়…
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সেই আন্দোলনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষা তো আজ একটা কিংবদন্তির জায়গায় ঠাই পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। পরবর্তী সময় আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ১১ জন। সেই আন্দোলনের কথাও ছড়িয়ে পড়েছে অনেকের মধ্যে। আর তাদের ভিড়েই দাঁড়িয়ে আছে পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চল। আজকের পুরুলিয়া জেলার জন্মও সেই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই। অথচ ইতিহাসের একটা কোণেই সরে আছে সেই অধ্যায়।
সূত্রপাত অবশ্য ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে। ১৯০৫ সাল। অবিভক্ত বাংলার বিশাল আয়তনের জন্য শাসনকার্য ঠিকথাক হচ্ছে না— এই যুক্তি দিয়েই লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন। তৈরি হল আলাদা দুটি রাজ্য— বিহার ও ওড়িশা। আর এই সময়ই মানভূম ও ধলভূম জেলাদুটিকে সরিয়ে ওই দুই নতুন রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঠিক এই জায়গা থেকেই শুরু হয় সমস্যা। মানভূমের অধিকাংশ মানুষই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা সবাই বাঙালি। তাহলে বাংলা ছেড়ে এই জেলাকে ভিন রাজ্যে চলে যেতে হবে কেন? প্রতিবাদ উঠলেও কার্যকর হয়নি সেসব।
এরপরই ১৯৩৫ সালে ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের উদ্যোগে বিহারে তৈরি হয় ‘মানভূম বিহারী কমিটি’। বহুদিনের জমে থাকা আগুনে যেন নতুন করে ঘি পড়ে। তখনও মানভূমের অধিকাংশ বাসিন্দাই বাঙালি; প্রধান ভাষা বাংলা। তাও এমন উদ্যোগ কেন নেওয়া হল, বুঝতে পারলেন না কেউ। শুরু হল প্রতিবাদ। পি আর দাসের উদ্যোগে পাল্টা ‘মানভূম সমিতি’ নামের একটি সংগঠন তৈরি হল। স্বাধীনতার পর এই ভাষা যে একটা মুখ্য জায়গা নেবে, সেটা বোধহয় বোঝা যাচ্ছিল তখন থেকেই। জাতীয় কংগ্রেসের সভা-সমিতির ভেতর সেই তত্ত্বও ঘুরছিল। কেবল অপেক্ষা ছিল স্বাধীনতার…
অবশেষে ১৯৪৭ সালে এল সেই কাঙ্খিত দিন। দেশ ভাগ হল, কাঁটাতারের সীমানা তৈরি হল। মধ্যরাতে নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্নের কথা শোনালেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। স্বাধীনতার পরই তিনি বুঝলেন, এই দেশের কোণায় কোণায় রয়েছে বৈচিত্র্য। একে একসূত্রে গেঁথে রাখাই হবে সবচেয়ে ‘চ্যালেঞ্জিং’। আরও মুশকিল হল ভাষা। এক এক জায়গার মানুষ এক এক ভাষায় কথা বলেন। কাজেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তৈরি হল বিশেষ কমিশন।
একবছর পর, সেই কমিশনই তুলে আনল অন্য একটি তত্ত্ব। এই দেশ তো এখন স্বাধীন, একসঙ্গে টিকে থাকাই হবে এর মূল মন্ত্র। সেখানে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য তৈরি হলে প্রাদেশিকতা বাড়বে না? এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিল নতুন একটি শব্দবন্ধের - ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’। হিন্দি ভাষাকেই গোটা দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, ভেতরে ভেতরে এটাই যেন মন্ত্র হয়ে উঠল অধিকাংশের। স্বাধীনতার পরপরই যে পথে পা বাড়িয়েছিল বিহার সরকার। রাজ্যের মানুষের হিন্দি শেখা বাধ্যতামূলক— এই মর্মে শুরু হয়েছিল আইন জারি। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষা যাতে মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে সেই চেষ্টাও করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন
প্রয়াত শবরদের দিনবদলের পথিকৃৎ নন্দলাল শবর, শোকস্তব্ধ পুরুলিয়া
তখনও মানভূম জেলা বিহারের মধ্যেই। এবং তখনও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি পুরুলিয়া নামের কোনো জেলা। বিহারে বাংলা ভাষার অবনমন ও হিন্দির প্রচার মানভূমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। ভেবেছিলেন, স্বাধীনতার পর হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু না! তখনও এখানকার অধিকাংশ মানুষের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। শুরু হল বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন। কাঁটাতারের ওপারে পূর্ব পাকিস্তান আর এপারে মানভূম— সবাইকে মিলিয়ে দিয়েছিল বাংলা ভাষা। মানভূমের জেলা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন অসংখ্য নেতা কর্মী। অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, ভজহরি মাহাতো-সহ নেতারা একত্রিত হয়ে তৈরি করেন ‘লোকসেবক সংঘ’। বিহার সরকারও অবস্থা বুঝে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বহু নেতা আহত ও গ্রেফতার হন। কিন্তু আন্দোলনের তেজ একটুও কম হয়নি…
এরই মধ্যে টুসু গানকে কেন্দ্র করে জন্ম নিল নতুন একটি ঢেউ। শুরু হল ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। দাবি ছিল একটাই, এভাবে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। নেতারা জেলের ভেতর, মেয়েদের ওপর চলছে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন; আর বাইরে চলছে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গ আর বিহার রাজ্য প্রশাসনের ভেতর চলছে একের পর এক বৈঠক। দুই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংয়ের মধ্যে চলছে জমি হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা। তারই মধ্যে নিষিদ্ধ হল টুসু সত্যাগ্রহ। মানভূমবাসীরা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এভাবেই বিহারের এককোণে পড়ে থাকবেন তাঁরা? এই আন্দোলন বিফলে যাবে?
একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। ১৯৫৬ সাল। এপ্রিল মাস। মাথার ওপর তাপ বাড়ছে সূর্যের। তারই মধ্যে পাকবিড়রা গ্রাম থেকে শুরু হল পদযাত্রা। নেতৃত্বে অতুলচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। হাজার হাজার মানুষ যোগ দিল সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলে। কলকাতায় গিয়েই তাঁরা তাঁদের দাবি জানাবেন। এদিকে যে ১৪৪ ধারা জারি হয়ে আছে! কোনো পরোয়া নেই। হাঁটা শুরু করলেন সবাই। টানা ১৭ দিন পদযাত্রা চলার পর কলকাতায় পৌঁছলেন তাঁরা। এদিকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে গ্রেফতার করা হল প্রায় ৯৬৫ জনকে। এদিক ওদিক থেকে আরও কয়েক হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়। এদিকে মানভূমের বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন পৌঁছে গেছে দিল্লির দরবারেও। বিহার প্রশাসনও বুঝে গেছে, মানভূমকে আর হাতে রাখা যাবে না…
আরও পড়ুন
ধানের জমিতেই শুরু হতে চলেছে মাছচাষ, কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব পুরুলিয়ায়
শেষ পর্যন্ত এল সেই দিন। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে লোকসভা ও রাজ্যসভা— দুটি জায়গাতেই পাশ হয় বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল। সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর নতুন রাজ্য গঠন ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। অবশেষে, ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর, মানভূম অন্তর্ভুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গে। হিন্দি আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে বাংলা ও টুসু-ভাদুর কোলে ফিরে এলেন সেখানকার বাসিন্দারা। নতুন নাম হল ‘পুরুলিয়া’। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় তৈরি করল মানভূম এবং সেখানকার বাসিন্দারা। হার না মেনে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ে নিজের হক ছিনিয়ে আনা— এ কি কম কথা! এখন আর কেউ বাংলায় কথা বলতে বাধা দেবে না…
একদিন থেকে দেখতে গেলে, মানভূমের ভাষা আন্দোলনই ছিল বাংলা ভাষাকে ঘিরে প্রথম আন্দোলন, যা পরিণতি পেয়েছিল। এরপর বাংলাদেশের আন্দোলন, আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন— এই সারণি দিয়েই হেঁটেছে ইতিহাস। কিন্তু কোথাও হারিয়ে গেছে মানভূমের কথা, হারিয়ে গেছে পুরুলিয়ার জন্মবৃত্তান্ত। দীর্ঘ চার-পাঁচ দশক ধরে যে আন্দোলনের পথ চলা। ইতিহাস বলে, সময়ের নিরিখে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন এটি। অথচ সেই ইতিহাস পেছনেই থেকে গেছে। অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষের কথাও কি মনে রেখেছে কেউ? আজকে, এই ভাষা আন্দোলনের বর্ষপূর্তির দিনে বারবার ফিরে দেখা সেই দিনটিকে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, বাংলা ভাষার জন্য এমন সংগ্রামকে যে মনে করতেই হয়…
তথ্যসূত্র-
১) ‘বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন করেই জন্ম নিয়েছিল পুরুলিয়া’, সৌমেন শীল, কলকাতা ২৪X৭
২) ‘ঠিক ৬৫ বছর আগে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েই জন্ম নিয়েছিল আজকের পুরুলিয়া’, বঙ্গদর্শন
আরও পড়ুন
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে পিসিআর যন্ত্র দিচ্ছে পুরুলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়
Powered by Froala Editor