১৯০০ সাল। নতুন একটি শতাব্দীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষ। তখনও অবিভক্ত বাংলা। চক্রধরপুরের হাওয়া ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছে। আশেপাশের গ্রামে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। ‘সিং বোঙ্গা’-কে খুঁজে বের করতেই হবে। হঠাৎই দূরের আকাশে দেখা গেল ধোঁয়া। ওদিকে তো যমকোপাই বন। সেখান থেকেই ধোঁয়া উঠছে। তবে কি আগুন টাগুন লাগল নাকি? একরাশ সন্দেহ নিয়ে এগিয়ে গেল পুলিশ। না, আগুন লাগেনি। তাহলে নির্ঘাত ভেতরে কেউ লুকিয়ে আছে। প্রমাদ গুনল ব্রিটিশরা। গ্রামের কয়েকজনকে মোটা টাকা ও খাবারের লোভ দেখাল তাঁরা। যদি কিছু হয়…
আজকের বিহার, ঝাড়খণ্ড তখন অবিভক্ত বাংলার অঙ্গ। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের বসবাস সেখানে। নিজেদের মতো বেড়ে উঠেছেন এঁরা। কিন্তু খাবার আর অর্থের সমস্যা যেন নিত্যসঙ্গী। ব্রিটিশ পুলিশের দলটি যখন টাকা আর খাবারের লোভ দেখাল, স্বভাবতই সেই ফাঁদে পড়ল ঐ মানুষগুলো। বনের ভেতর ঢুকে দেখে এল পরিস্থিতি। কে আছে ওখানে? উত্তর শুনে পুলিশের মুখ হাঁ। সত্যিই তিনি আছেন বনের ভেতর? সতর্ক হয়ে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। দেখলেন, একজন আদিবাসী নারী ভাত রাঁধছেন। সেই ধোঁয়াই গাছপালা ভেদ করে আকাশে চলে যাচ্ছে। আর খানিক তফাতেই বিশ্রাম করছেন— সিং বোঙ্গা! বিরসা মুন্ডা! ১৯০০ সাল। গ্রেফতার করা হল ‘উলগুলানের’ নায়ককে…
পঁচিশ বছর আগের কথা। উলিহাটুর সুগানা মুন্ডা এবং করমি হাটুর ঘরে জন্ম নিল ফুটফুটে এক ছেলে। নাম দেওয়া হল ‘বিরসা’। গ্রামের পাঠশালাতেই অক্ষর চিনতে শেখা, চোখের সামনে দেখা মুন্ডা, ওঁরাও, সাঁওতালদের সংস্কৃতি। এই রুখুশুখু মাটি, এই গাছ তাঁদের নিজেদের। সেই সবকিছু নিয়েই মেতে উঠল বিরসা। আর ছিল পড়াশোনা। সবকিছুকে জানা, শেখার চেষ্টা, কৌতূহল তাঁর ছিল অফুরন্ত। বাঁশি বাজাতে বাজাতে হেঁটে যেতেন গ্রামের রাস্তা দিয়ে। সেই বাঁশির সুরেই হয়তো কেটে যেত জীবনটা।
সিপাহী বিদ্রোহ পেরিয়ে গেছে বেশ কিছু বছর আগে। ইংরেজ সরকার আগের থেকে আরও শক্তিশালী। তাঁদের এবং অন্যান্য বিদেশিদের সৌজন্যে জায়গায় জায়গায় তৈরি হয়েছে মিশনারি স্কুল, গির্জা। বিশেষ করে, প্রত্যন্ত গ্রাম এবং আদিবাসী এলাকার মানুষদের মধ্যে যাতে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে, তা নিয়েই কাজ শুরু হয়েছিল। তবে সেটাই বেশ কিছু জায়গায় ধর্মান্তরণের পথে বাঁক নেয়। খ্রিস্টান ধর্মের ছাতার তলায় এলেই আদিবাসীরা মুক্তি পাবে, এমন একটা মতবাদ প্রচার হয়েছিল তখন। যার কবলে পড়ে যান কিশোর বিরসা মুন্ডাও। নিজের গ্রাম থেকে চাইবাসার এক জার্মান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়ে যান তিনি। এবং প্রায় একইসঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মেও দীক্ষিত হতে হয় তাঁকে।
মোহ ভঙ্গ হতে বেশি দেরি হয়নি। ১৮৯০ সালে চাইবাসা ছেড়ে আবারও নিজের গ্রামে ফিরে আসেন বিরসা মুন্ডা। আদিবাসী মানুষগুলোর সম্পর্কে এই সাহেবদের ধারণা যে ঠিক কী, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে ভেবেছিলেন, পড়াশোনা শিখে তারপর যদি কিছু করা যায়। কিন্তু না, ওভাবে হবে না। বিরসার জন্মের আগে থেকেই আদিবাসী এলাকাগুলোতে শুরু হয়ে গিয়েছিল বিদ্রোহ। ইংরেজরা যে তাঁদের জায়গা, জমি সব কেড়ে নেবে, সেসব একটু একটু করে বুঝতে পারছিলেন। শুরু হয় ‘সরদারি লড়াই’। বন্দুকের উল্টোদিকে তির-ধনুক হাতে নেমে পড়ল আদিবাসীরা। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু অভাব ছিল একটি প্রধান জিনিসের— নেতৃত্ব। এমন নেতা, যে সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়কে এক বাঁধনে বাঁধবে। সবাইকে একজোট করে ‘দিকু’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে। অবশেষে সেই জায়গায় উঠে এলেন বিরসা মুন্ডা। বয়সে ছোটো হলেও তাঁর তেজ, তাঁর কথা যেন সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত।
চাইবাসা থেকেই একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলেন বিরসা। এই সাদা চামড়ার লোকেরাই আসল ‘দিকু’, অর্থাৎ শত্রু। যে মাটিতে তাঁদের জন্ম, সেখান থেকেই আলাদা করে দেওয়ার চক্রান্ত করছে তাঁরা। আর এঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় জমিদার, জোতদাররা। ব্রিটিশদের আজ্ঞাবাহী এই লোকগুলো নিজের দেশকেই অপমান করছে, বিশ্বাসঘাতকতা করছে; আর মুন্ডা, ওঁরাও, সাঁওতাল, কোল-সহ আদিবাসীদের উৎখাত করছে। সন্দেহ আরও তীব্র হল, যখন ১৮৯৪ সালে ভারতের অরণ্য আইন প্রয়োগ করল ব্রিটিশরা। এতদিন যে জঙ্গল, যে গাছপালা, খোলা হাওয়ার হাত ধরে আদিবাসীরা বেড়ে উঠছিল; এবার সেখানেই কোপ ফেলা হল। নিজেদের শিকড় থেকেই বিতাড়িত হলেন তাঁরা। ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত জঙ্গলেও ব্রিটিশদের দখলদারি শুরু হল। ফলে, অথৈ জলে পড়ল সেখানকার আদিবাসীরা।
আরও পড়ুন
হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই; বাংলার দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনেই জন্ম পুরুলিয়ার
এইসবের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার ব্রত নিয়েই উঠে এলেন বিরসা মুন্ডা। সবার প্রথমে সমস্ত আদিবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। তৈরি করলেন নিজের নতুন ধর্ম - মুন্ডা ধর্ম। ইংরেজ আর স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে হাতে উঠে এল অস্ত্র। আদিবাসীরা এই প্রথম যেন একজন প্রকৃত নেতাকে পেলেন। নিজেদের জায়গা রক্ষা করতে হবে, শত্রুদের তাড়াতে হবে। কে তাড়াবেন? বিরসা ভগবান! মাত্র কুড়ি বছর বয়স তখন। লোকের কাছে তখন তিনি ‘ধরতি আবা’, রক্ষাকর্তা। হাতের বাঁশি নামিয়ে রাখলেন বিরসা। উঠে এল তির-ধনুক। নতুন করে আন্দোলন শুরু হল আদিবাসী অঞ্চলে।
১৮৯৫ সালে একবার গ্রেফতার হলেন বিরসা। কিন্তু বেশিদিন কারাগারের পেছনে রাখা গেল না তাঁকে। ১৮৯৭ সালেই বেরিয়ে এলেন তিনি। তারপরেই শুরু হল ‘উলগুলান’-এর প্রস্তুতি। আদিবাসীদের কিছুতেই নিজেদের জায়গা থেকে বিতাড়িত করা যাবে না— এটাই ছিল লক্ষ্য। একটু একটু করে দলে বাড়তে লাগল লোক। কেবল মুন্ডারাই নন, অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় থেকেও বহু মানুষ বিরসার সঙ্গে যোগ দিলেন। ডোম্বরি পাহাড়ে তৈরি হল আস্তানা। ১৮৯৯ সালে শুরু হল বিদ্রোহ। গেরিলা পদ্ধতিতে বিরসা বাহিনীর আক্রমণ দিশাহারা করে দিল ব্রিটিশদের। কখন, কীভাবে, কোন দিক দিয়ে হামলা করবে বুঝতেই পারেন না কেউ। বিরসা মুন্ডা ও তাঁর বাহিনীর হাতে একের পর এক ইংরেজ মারা যেতে লাগল। রাঁচি এবং অন্যান্য শহরে জ্বলল আগুন। পুড়ে গেল সরকারি ভবন।
এর মধ্যেই ডোম্বরি পাহাড়ে বিশাল সেনা পাঠাল ইংরেজ সরকার। মারা পড়ল কয়েকশো আদিবাসী মানুষ। কিন্তু বিরসা মুন্ডার নাগাল পেলেন না কেউ। তিনি যে ‘সিং বোঙ্গা’, ‘ধরতি আবা’। ভগবানকে কি ধরা যায় এভাবে? কিন্তু বেশিদিন পালাতে পারলেন না বিরসা। ১৯০০ সাল। যমকোপাই বনে একটু বিশ্রাম করার জন্য এসেছিলেন তিনি। আর তখনই তাঁকে গ্রেফতার করল ব্রিটিশ পুলিশ। সঙ্গে গ্রেফতার আরও বহু যোদ্ধা। আর সঙ্গে নির্বিচারে আদিবাসীদের হত্যা করা হল। হাতে হাতকড়া পরিয়ে বিরসা মুন্ডাকে নিয়ে যাওয়া হল রাঁচির কারাগারে। চলল অকথ্য অত্যাচার। বিচার অবশ্য হয়েই গিয়েছিল। আদিবাসীদের ‘দেবতা’কে ফাঁসিতেই চড়ানো হোক…
১৯০০ সালের ৯ জুন। আর একদিন পরেই বিরসা মুন্ডার ফাঁসি। হঠাৎই রাঁচি কারাগার থেকে খবর এল, বিরসা মুন্ডা মারা গেছেন। সবাই হতবাক। কী করে হল? জেল কর্তৃপক্ষ বলল, রক্ত বমি আর আমাশার ফলেই মারা গেছেন বিরসা। সত্যিই কি তাই? পরে অবশ্য জানা যায়, বিষপ্রয়োগের ফলে মৃত্যু হয় তাঁর। তাহলে কি পরিকল্পিত হত্যা? জানা যায় না। অবশ্য আজও আদিবাসী সমাজ ‘হত্যা’র তত্ত্বেই বিশ্বাস করেন। আদিবাসী সমাজের নিয়ম অনুযায়ী বিরসা মুন্ডাকে কবর দেওয়ার কথা। না, সেটা হয়নি। ইংরেজরা বিরসার দেহ সামনেই আনেনি; গোপনেই দাহ করা হয় তাঁকে। উলগুলান এবং মুন্ডা বিদ্রোহকে কঠোরভাবে দমন করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিরসা মুন্ডাকে কি চেপে রাখা যায়? একমাত্র আদিবাসী নেতা হিসেবে তাঁর ছবি ঠাঁই পেয়েছে ভারতের সংসদে। আজও বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছোটনাগপুরের প্রতিটি রাস্তায় ঘুরে বেড়ান তিনি। এই মাটি, এই গাছ, এই জঙ্গল যে তাঁর দেশ, তাঁদের দেশ…
তথ্যসূত্র-
১) ‘বিরসা মুন্ডা’, সব বাংলায়
২) ‘Birsa Munda— freedom fighter ‘Dharti Abba’ who championed tribal rights’, Madhavi Pothukuchi, The Print
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কেঁচো খুঁড়তে কেউটে, চাষের জমি থেকে উদ্ধার সিপাহী বিদ্রোহের বন্দুক