১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। তবে ২২শে শ্রাবণে বললেই দিনটাকে ভালো চেনা যায়। বাঙালির মনের আকাশজুড়ে সেদিন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতা ছাড়িয়ে অনন্তলোকে যাত্রা করলেন কবিগুরু। তাঁর শরীরের অবস্থা খারাপ ছিল আগে থেকেই। সেদিন সকালেও ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এবং ডাক্তার ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় এসে দেখে গিয়েছিলেন কবিকে। লজ্জিত মুখে বিদায় নিলেন তাঁরা। বেতারকেন্দ্র থেকে তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর কবির স্বাস্থ্যের খবর জানানো হবে শ্রোতাদের। সেই মতো জোড়াসাঁকো থেকে খবর পৌঁছতে থাকল অফিসে। আর সেই খবর সম্প্রচার করে চললেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
অতঃপর এল সেই অন্তিম সংবাদ। ঘড়িতে সময় তখন ঠিক দুপুর ১২টা ১৩ মিনিট। এরপর এই খবর পৌঁছল বেতারকেন্দ্রে। ঠিক হল, কবির অন্তিম যাত্রার ধারাবিবরণী শোনানো হবে। পরিকল্পনা অবশ্যই সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। টেলিফোনে খবর নিতে নিতেই সেই বিবরণ শোনাতে থাকলেন তিনি। শুরুর কথাগুলো ছিল এরকম -
“ঠাকুরবাড়িতে বেশিক্ষণ শবদেহ রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি প্রয়াণ করেছেন বিকেলের মধ্যে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেই হবে। সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে আমরাও নিমতলা শ্মশানে এসে হাজির। ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...।”
আর সেইসঙ্গে ধারাভাষ্যকারের ভরাট গলার পাশাপাশি সম্প্রচারিত হল রবিহীন বাংলা সাহিত্য জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামের গলা। ইথারে ভেসে এল তাঁর স্বরচিত কবিতার লাইন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। কবির শেষ যাত্রার সঙ্গীও যেমন ছিলেন অনেকে, তেমনই বাকিরা সেই যাত্রার সঙ্গী হলেন বেতারের অনুষ্ঠানে। বাংলায় এমন অনুষ্ঠান সেই প্রথম। এর আগে আর কারোর অন্তিমযাত্রার ধারাবিবরণী শোনেননি বাংলার মানুষ। এরপর অবশ্য ডা. বিধানচন্দ্র রায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবরও শুনিয়েছিলেন বীরেদ্রকৃষ্ণ।
শুধুই মৃত্যুসংবাদই নয়, বীরেন্দ্র কৃষ্ণের হাত ধরে অসংখ্য অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিল আকাশবাণী। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের কথা তো সকলেরই জানা। এখনও বেতারের এই অনুষ্ঠানকেই মহালয়া বলে ভুল করেন অনেকে। ভুলে যান, মহালয়া তো কেবল একটা তিথি। তবে এছাড়াও রেডিও বললেই মনে আসে ক্রিকেট, ফুটবলের মতো খেলার ধারাবিবরণী। ইন্টারনেট-টেলিভিশনের অনেক আগে খেলার মাঠে না গিয়েও সেই খেলার রস আস্বাদন করা যেত রেডিওতেই। এই উদ্যোগও কিন্তু নিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণই। তবে খেলার নিয়মকানুন তো তিনি তেমন জানতেন না। তাই ভুলও করেছেন অনেকবার। যেমন একবার এক টানটান ম্যাচে গোলকিপার কোনোরকমে বল জালে জড়িয়ে পড়া থেকে আটকালেন। আর বীরেন বাবু তখন চিৎকার করে উঠলেন, হ্যান্ডবল হয়েছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে কেউ ভুল শুধরে দিলেন।
আসলে রেডিওই ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জীবনের সাধনা। তাই রেলের চাকরি করতে করতেও সময় পেলেই চলে আসতেন আকাশবাণীর কেন্দ্রে। ১৯০৫ সালের ৪ আগস্ট রাধারমণ মিত্র লেনের এক উচ্চশিক্ষিত বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন। অঙ্কের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা ছিল বরাবরই। কিন্তু আবৃত্তির প্রতি ছিল এক অদ্ভুত নেশা। ছোট থেকেই মধুসূদনের মতো কবির শক্ত শক্ত কবিতাও মুখস্ত বলতে পারতেন তিনি। আর সেই আবৃত্তির সূত্রেই যোগাযোগ বেতারের সঙ্গেই। সেই থেকে যেন সেটাই হয়ে উঠল তাঁর ঘরবাড়ি।
আরও পড়ুন
মসজিদে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ, রাখির বাঁধনে জড়িয়ে নিলেন মৌলবীদেরও
শোনা যায় এক বর্ষার দিনে বেতারের কোনো শিল্পীই স্টুডিওতে পৌঁছতে পারলেন না। মাইক হাতে বসে আছেন একা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, এবার একটু পিয়ানো শুনুন। সেই পিয়ানোর শিল্পী ভাষ্যকার নিজেই। প্রথম অনুষ্ঠান শেষ হল। কিন্তু বৃষ্টি তখনও থামল না। ঘোষণা করলেন, পরবর্তী অনুষ্ঠান রবীন্দ্রসঙ্গীত। বলা বাহুল্য, এখানেও শিল্পীর নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
কিন্তু সারাজীবন এত পরিশ্রমের দাম সেভাবে কোনোদিনই পাননি তিনি। বাঙালি শ্রোতাদের কাছেও যেখানে মহালয়ার অপর নাম ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, সেখানে তাঁকে বাদ দিয়েই হয়েছিল ১৯৭৬ সালের অনুষ্ঠান। কর্তারা হয়তো ভেবেছিলেন উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তা অনুষ্ঠানকে আরও জনপ্রিয় করে তুলবে। কিন্তু ফল হয়েছিল উল্টো। পর্দার মহানায়ককে চণ্ডীপাঠের অনুষ্ঠানে মেনে নিতে পারেননি কেউই। বাধ্য হয়েই সেবার ষষ্ঠীর দিনে আবার সম্প্রচারিত হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তবে এসবের মধ্যে কিন্তু একটুও রাগ করেননি বীরেন বাবু। ইগো জিনিসটাই যেন তাঁর মধ্যে ছিল না। এমনকি প্রথাগত বাচিকশিল্পীরা উত্তম কুমারের উচ্চারণ অপছন্দ করলেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলতেন রোমান্টিক দৃশ্যের জন্য ওই হাফ-টোনই সবচেয়ে ভালো মানায়। এমনকি এই ঘটনার বছর পাঁচেক পর যখন উত্তমকুমার বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে, সেদিনও সেই অন্তিম যাত্রার ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন তিনিই। আপামর বাঙালি শ্রোতা সেদিন শুনেছিল, সেই ভরাট গলাও আবেগে কেঁপে-কেঁপে উঠেছে। এভাবেই তিনি বলে চলেছেন,
“যে সুন্দর কমনীয় শরীর মুখমণ্ডল এতকাল তাঁর অজস্র ভক্তকে আনন্দ দিয়েছে, সেই শরীরে আগুন স্পর্শ করল। ছোঁয়ালেন তাঁর প্রিয়তম পুত্র গৌতম। মহানায়কের নশ্বরদেহ ঘিরে এখন আগুনের লেলিহান শিখা। একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তাঁর শরীরকে। আমি দেখতে পাচ্ছি, কাতারে কাতারে মানুষ এসে একবার পাদপদ্ম স্পর্শ করতে চাইছে।”
আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী
Powered by Froala Editor