ইয়াসে বাস্তুহারা পাখির দল, গোসাবার পাখিরালয়ের বুকে শূন্যতা

সকাল হতেই কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় না আর। জলাশয়ের উপরে ডানার ঝটপট শব্দে মুখরিত হয়ে থাকে না দিন। এই সমস্ত শব্দ ও দৃশ্যের জন্যই তো জায়গাটির নাম পাখিরালয়। অথচ গত একমাসের বেশি সময় ধরে পাখিশূন্য হয়েই পড়ে রয়েছে সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের এই অভয়ারণ্য। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর থেকেই নিরুদ্দেশ পাখিরা। আদৌ কি কোনোদিন ফিরে আসবে তারা? দুশ্চিন্তায় রয়েছেন পরিবেশকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই।

১৯৮০-র দশকে সরকারি সংরক্ষণ প্রকল্পের সৌজন্যে তৈরি হয় এই অভয়ারণ্য। মূলত পাখিদের সুরক্ষার জন্যই এই অরণ্য তৈরি। তাই নাম রাখা হয় পাখিরালয়। তবে পাখিরালয়ের ইতিহাস আরও প্রাচীন। বিশ শতকের শুরুর দিকেই দানিয়েল হ্যামিলটন সাহেব জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গা তৈরি করেছিলেন। বুনো গাছের ঝোপ থেকে কিছু গাছ কেটে ফেলেছিলেন, যাতে পাখিরা মাটি এবং জলাশয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে খাবার সংগ্রহ করতে। আর এভাবেই প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল হয়ে উঠেছিল পাখিরালয়। কিন্তু একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে সেই বাসস্থান আজ বিপন্ন।

পাখিরালয় কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, ইয়াসে ঝড়ের প্রভাব তেমন তীব্র হয়নি। মূলত খাদ্যের অভাবেই বাসস্থান ছেড়ে গিয়েছে পাখিরা। ঝড়ের পরেই জোয়ারের জল এসে প্রায় সমস্ত জলাশয়ে ঢুকে পড়েছে। নোনা জলে কাতারে কাতারে মাছ মারা গিয়েছে। আর মাছ না থাকলে পাখির খাবারে টান পড়বেই। পরিবেশকর্মী জয়িতা কুণ্ডু বলছেন, “শুধু মাছই নয়, সমুদ্রের জলের প্রভাবে নানা অণুজীবও মারা গিয়েছে। এরাও পাখির খাদ্য। আর যেখানে খাদ্য নেই, সেখানে কোনো প্রাণীই থাকে না।” তবে পাখিরা কোনোদিন ফিরবে না, এমনটা মনে করেন না জয়িতা। তাঁর কথায়, “উপযুক্ত বাসস্থান তৈরি হলে আবার পাখিরা ফিরে আসবে।” কিন্তু পাশাপাশি থেকে যাচ্ছে সংশয়ও। “বছর বছর যদি এভাবে ঘূর্ণিঝড় আসতে থাকে, তাহলে কি কোনোদিন পাখিদের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে উঠবে সুন্দরবন?” বনবিভাগের কর্মীদের মতেও, পাখিরালয়ে সমস্ত প্রজাতির পাখির ফিরে আসতে এখনও অন্তত ৩ বছর সময় লাগবে। কিন্তু এর মধ্যেই আবারও ঘূর্ণিঝড় এসে পড়লে কিছু করার থাকবে না।

তবে কি কিছুই করার নেই? জয়িতা কুণ্ডুর মতে, “একমাত্র ম্যানগ্রোভ অরণ্যই পারে সুন্দরবনকে বাঁচাতে। গোটা বাস্তুতন্ত্র তো গড়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ গাছের উপর নির্ভর করে। তাই যেটুকু বন অবশিষ্ট আছে, তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবেই। সেইসঙ্গে আরও বেশি করে ম্যানগ্রোভ গাছ লাগাতে হবে।” সুন্দরবন যদি না বাঁচে, তাহলে যে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেরই আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।

আরও পড়ুন
ইয়াস-বিপর্যয়ের মধ্যেই আগামী ঘূর্ণিঝড়ের চিন্তা, সমাধান অজানা সুন্দরবনবাসীদের

তথ্যসূত্রঃ Why did a bird sanctuary in the Sunderbans suddenly lose its feathered occupants recently?, Moumita Chaudhuri  , The Telegraph Online

আরও পড়ুন
পূর্বাভাস ছিল না ইয়াস-পরবর্তী জোয়ারের, বিধ্বস্ত সুন্দরবনের ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ প্রণবেশ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ইতিহাসের সলিলসমাধি, ইয়াসের তাণ্ডবে নিশ্চিহ্ন ফ্রেজার সাহেবের বাংলোও