তুরস্কের কানাকচি প্রদেশের ব্ল্যাক সি অঞ্চলের কয়সয় গ্রাম। পার্বত্য উপত্যকার কোলে সবুজে সবুজে ছয়লাপ চারদিক। দেখে মনে হবে হয়তো নিপুণভাবে রূপকথার বাস্তবায়ন করেছেন কোনো গ্রাফিক্স ডিজাইনার। আর এমন মনোরম পরিবেশকে আরও মোহময় করে তুলবে সুরেলা পাখিদের গান। তবে এ গানের শিল্পী আসলে মানুষ। ঠিক কীরকম?
আসলে যাকে পাখির গান বলে ভুল করা হচ্ছে, তা হল কয়সয়ের একটি আঞ্চলিক ভাষা। পরিচিত বার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বা ‘পাখির ভাষা’ নামে। স্থানীয় নাম ‘কুস ডিলি’। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই পাখির ভাষা। কারণ, এই ভাষায় উচ্চারিত শব্দ নেই কোনো। কথা হয় সুরেলা শিসের মাধ্যমে।
তুরস্কের হুরিয়েট সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ভাষার জন্ম হয়েছিল আনুমানিক দু-আড়াই শতক আগে। মূলত ব্যবহৃত হত এই উপত্যকার রাখাল এবং কৃষিজীবী মানুষদের মধ্যে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতেই পারে, দুশো বছর আগে হঠাৎ করে এমন এক ভাষা তৈরি করা হল কেন? তার আগে কি কোনো প্রচলিত ভাষা ছিল না কয়সয়ে?
এই উত্তর পাওয়ার আগে বুঝতে হবে তুরস্কের এই গ্রামের ভৌগলিক অবস্থান এবং গঠন। পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত এই গ্রামে প্রতিটি বাড়ির মধ্যে দূরত্ব কমপক্ষে কয়েকশো মিটার। পাশাপাশি পথও বেশ দুর্গম। সেইসঙ্গে সময়টা মিলিয়ে নিলে বোঝা যাবে, মোবাইল তো দূরের কথা, টেলিফোন কিংবা টেলিগ্রামও আসতে ঢের দেরি তখন। কাজেই সাহায্য কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হত গ্রামবাসীদের। সেই সমস্যার সমাধান করতেই বেছে নেওয়া এমন অদ্ভুত ভাষা।
আরও পড়ুন
খোদ পশ্চিমবঙ্গেই বিলুপ্তির মুখে এই ১০টি ভাষা, দায়ী বাংলার আধিপত্য
আসলে আমরা সাধারণত যে ভাষায় কথা বলি তার কম্পাঙ্কের তুলনায় শিসের কমাঙ্ক কয়েকগুণ বেশি। এবং কম্পাঙ্ক বেশি হওয়ার দরুণ, বায়ুমণ্ডলে শোষিত না হয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে শব্দশক্তি। কাজেই বহুদূর থেকেই কথপোকথন সম্ভব এই ভাষায়। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে এই পদ্ধতিতেই কথা চালাচালি করেন কয়সয়ের গ্রামবাসীরা। তবে মানুষ তো অভ্যাসেরই দাস। ফলত সামনা-সামনি কথা বলতেও বর্তমানে ব্যবহৃত হয় ‘পাখিদের ভাষা’।
যে কোনো ভাষার যেমন শব্দভাণ্ডার থাকে, এই ভাষারও আছে তেমনই পৃথক পৃথক শব্দ। আর তা তৈরি হয় বিভিন্ন শিসের সংমিশ্রণে। এই ধরণের প্রায় ২০০টি আলাদা আলাদা শব্দের শিসের প্রচলন রয়েছে এই অঞ্চলে। বিশেষ কায়দায় ঠোঁটে আঙুল ঢুকিয়ে, জিভ ও দাঁতের অভিনব ব্যবহারে শিসের সেই তারতম্য তৈরি করেন এই ভাষার বক্তারা।
আরও পড়ুন
প্রাতিষ্ঠানিক বাংলার ‘আস্ফালন’, কোণঠাসা পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষাবৈচিত্র্যও?
তবে প্রযুক্তিই যেন শমন হয়ে দাঁড়িয়েছে পাখির ভাষার। মোবাইল এসে যাওয়ায় এই ভাষার গুরুত্ব অনেকটাই কমে গেছে কয়সয়ে। যার ফলে ধীরে ধীরে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে এই প্রাচীন ভাষা। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের অনেকেই চাকরির সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বাইরের শহরে। বর্তমানে এই ভাষার বক্তার সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার জন। তবে এখনও কিছু মানুষ, গর্বের সঙ্গেই ব্যবহার করেন এই ভাষা। আগ্রহী পর্যটকদের শেখানোর জন্যও এগিয়ে আসেন অনেকে।
এই ভাষার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে তুর্কির পনটিক পাহাড়ে প্রতি বছর আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক মেলার। ১৯৯৭ সালে প্রথম এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। মহামারীর ঠিক আগে ২০১৯ সালে প্রথাগত শিক্ষার মধ্যেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এই ভাষার। তাছাড়া ২০১৭ সালে ইউনেস্কো থেকে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আখ্যাও দেওয়া হয়েছে এই ভাষাকে। বাঁচিয়ে রাখার জন্য নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কর্মসূচিও।
আরও পড়ুন
ক্রিকেট খেলতে শিখেছেন চিনা ভাষা, অবনীন্দ্রনাথের প্রহার লজ্জা দিয়েছে বার্ধক্যেও
তবে শুধু কয়সয় নয়, পৃথিবীতে প্রায় ৫৭টি এই ধরণের স্বীকৃত ভাষা রয়েছে। যা কথিত হয় শিসের মাধ্যমেই। শুধু তুর্কিতেই আরও চারটি দ্বীপে প্রচলিত রয়েছে এমন ‘হুইসল ল্যাঙ্গুয়েজ’। তাছাড়া ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকাতেও বহু প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মানুষেরা কথা বলেন শিসের মাধ্যমে। তবে মূল বিষয় হল প্রতিটি ভাষায় বর্তমানে বিপন্ন। একদিকে যেমন প্রযুক্তি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে তাদের, তেমনই বহির্বিশ্বের এবং অন্যান্য ভাষার প্রভাবেও আরও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে শিসের ভাষাগুলি। আর কয়েক বছরের মধ্যেই যে তারা অবলুপ্ত হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে, তা বলার অপেক্ষা থাকে না…
Powered by Froala Editor