“২০২০-তে প্রথমবার বাপিদার বাড়ি যাই। সেই প্রথম আমার প্রোটাগনিস্টকে সামনে থেকে দেখা। বাপিদার ওই ক্যানভাসে-মোড়া ঘর— সেটা ভোলবার নয়। সারা দেওয়ালজুড়ে লোকেরা গান লিখে রেখেছে, এঁকে রেখেছে। সেই প্রথমবার বাপিদার বাড়িতে যাওয়া থেকে কিছুদিন আগে হসপিটালে ওঁকে দেখতে যাওয়া— এই পুরো জার্নিটায় এত পজিটিভ একজন মানুষকে আবিষ্কার করেছি, চিনেছি— সেটা আমার কাছে একটা বড়ো প্রাপ্তি।”
বলছিলেন ঋষিতা দে। প্রসঙ্গ, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র (Moheener Ghoraguli) শেষ তথা আদি ঘোড়া তাপস দাস ওরফে বাপিদার জীবনী।
আধুনিক বাংলা গানের দুনিয়ায় এক বর্ণময় অধ্যায় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। আর সেই অধ্যায়ের অন্যতম শরীক বাপিদা। ১৯৭৫ সালে প্রথম বাংলা তথা ভারতীয় ব্যান্ড হিসাবে জন্ম নিয়ে ‘মহীন’। তারপর কেটে গেছে ৪৮টা বছর। কাল্টে পরিণত হয়েছে দামাল বাঙালি সঙ্গীতকারদের লেখা, গাওয়া এবং সম্পাদিত গানগুলো। অথচ, এমন একটা কাল্টের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও প্রচারের আলোর আড়ালেই থেকে গেছেন তাপস বাপি দাস (Tapas Bapi Das)। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে খুচরো লেখালিখি হয়েছে ঠিকই, তবে দু’মলাটে এমন এক ব্যক্তিত্ব ধরতে চাওয়ার প্রচেষ্টা?
‘মহীন’-এর ৪৮ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম কোনো আস্ত গ্রন্থ প্রকাশিত হল বাপিদার জীবন, যাপনচিত্র এবং দর্শন নিয়ে। জীবনী (Biography) আকারে ধরা হল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক লড়াই-এর ছবি। নেপথ্যে ঋষিতা দে। চলতি বইমেলাতেই প্রকাশ পেল তাঁর লেখা গ্রন্থ, বাপিদার জীবনী, ‘রিইনকার্নেশন অফ দ্য ডার্ক স্ট্যালিয়ন— জার্নি অফ অ্যান আনসাং লেজেন্ড’ (Reincarnation of The Dark Stallion— Journey of an Unsung Legend)। গত ৪ তারিখ কলকাতা বইমেলার মৃণাল সেন মুক্তমঞ্চে প্রকাশিত হয় সংশ্লিষ্ট গ্রন্থটি। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত ছিলেন মধ্যমণি বাপিদা স্বয়ং। কলকাতা বইমেলায় ‘গুরুচণ্ডা৯’, ‘আজকাল’, ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘এখন বিসংবাদ’, ‘কলকাতা জার্নালিস্ট’-সহ বেশ কিছু বড়ো স্টলেই পাওয়া যাচ্ছে ‘জার্নি অফ অ্যান আনসাং লেজেন্ড’ ।
অবশ্য এই জার্নি শুধু বাপিদারই নয়, ঋষিতারও। আর এই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে ঢুকে পড়লে যে-কোনো পাঠকই হয়ে উঠতে পারেন এই বর্ণময় সময়যাত্রার অংশ। ঋষিতার কথায়, “বইটা শুধু বাপিদার যাপনকেই তুলে ধরে না, বরং ওঁর হাল না-ছাড়ার মানসিকতা, অদম্য লড়াই, জেদ— অনুপ্রেরণা দেবে প্রত্যেক পাঠককে। এই কাজটা করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি, যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ স্বীকার করবে সে ‘মহীন, সেদিনই সে আসল ‘মহীন’ হয়ে উঠতে পারবে, একটা সুন্দর আগামীর জন্য অপেক্ষা করতে পারবে। এটা একটা দর্শন।”
কথায় কথায় জানা গেল, বইটি ২০২৩-এর বইমেলায় বেরলেও তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল বছর তিন আগে। মহামারীর কারণে লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক পর পরই। বাপিদাকে কেন্দ্র করেই এখনও নবরূপে শ্বাস নিয়ে চলেছে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’-এর মধ্যে দিয়েই। ঘটনাচক্রে এই দলের গায়ক সুমন মিকি চট্টোপাধ্যায় ঋষিতার ভাই। সেই সূত্র ধরেই শুরু হয়েছিল বাপিদার জীবনী তৈরির কাজ। তবে এমন এক মানুষের জীবনী লেখার কাজ তো সহজ নয় মোটেই। তাই জড়তা ছিল কোথাও, খানিক ভয়ও হয়তো জমে ছিল মনের কোণে। অবশ্য পিছিয়ে আসেননি ঋষিতা।
লেখালিখির জগতে জড়িয়ে থাকলেও, ঋষিতা পেশাগত দিক থেকে কর্পোরেট আইনজীবী। থাকেন কলকাতার বাইরে। ফলে, দূরত্বও একটা প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই কাজে। তবে সেই দূরত্ব যেন নিজেই ঘুচিয়েছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ। অসুস্থতাও যেন দমাতে পারেনি তাঁকে। কখনও নিজেই ছোটো ছোটো করে লিখেছে পাঠিয়েছেন জীবনের নানান অভিজ্ঞতা, কখনও আবার গ্রন্থটিতে সংযুক্ত করেছেন আস্ত একটি অধ্যায়। “ম্যানুস্ক্রিপ্ট প্রকাশের কাছে সাবমিট করব, আর একদিন বাকি। বাপিদা তখন হসপিটালে। ওখান থেকেই ফোন করে জানালেন আরেকটা অধ্যায় যোগ করতে চান উনি। ক্যানসারের অভিজ্ঞতা নিয়ে। উনি ওই অবস্থাতেই পয়েন্ট আউট করে দিয়েছেন, আমি লিখেছি। একটা মানুষ মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখছেন, সেই অভিজ্ঞতা তিনি ছাড়া আর কারোর পক্ষে বলা সম্ভব নয়…”, অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিভোর হয়ে যাচ্ছিলেন ঋষিতা।
গ্রন্থটির পিছনে অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে ‘বুকস্ট্রিট’ পাবলিশারের কর্ণধার জিতেন্দ্র আনন্দ এবং ‘বুকবেকারস’-এর এজেন্ট সুহেল মাথুর। মাত্র একমাসেরও কম সময়ে তড়িঘড়ি করেই প্রায় প্রকাশিত হয়েছে এই বই। লক্ষ্য ছিল বইমেলা। আসলে শুধু বাপিদার গল্পকে পরবর্তীতে প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখাই এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাপিদার কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ারও এক উদ্যোগ। বিগত কয়েক মাস ধরেই মারণরোগ ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন বাপিদা। অনেকেই উদ্যোগ নিয়েছে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর। সেই তালিকাতেই রয়েছে এই গ্রন্থের নাম। বইটির লভ্যাংশও সাহায্য হিসাবে তুলে দেওয়া হবে ষাটোর্ধ্ব সঙ্গীতশিল্পীর হাতে। সবমিলিয়ে এই মানবিক উদ্যোগ বাংলা সঙ্গীতের বর্ণময় ইতিহাস সংরক্ষণ তো বটেই, কোথাও গিয়ে হয়ে উঠেছে বাপিদার হার না-মানা লড়াইয়ের এক অস্ত্রও…
Powered by Froala Editor