১৭৫ বছর আগে, ডাক্তারি পড়তে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন এই ‘দজ্জাল’ বাঙালি

তিনি বাঙালি। আবার আন্তর্জাতিক চরিত্রও। যে সময় ভারতীয়দের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হয়নি, পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে খানিক বাঁকা চোখেই দেখা হত, সে সময় তিনি সেটা নিয়ে অধ্যায়ন করেছেন। ‘কালাপানি’ পেরিয়ে, বিলেতেও গিয়েছিলেন ডাক্তারি বিষয়টাকে জানতে। তিনি, ডঃ সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রথম ভারতীয়।

ছোটো থেকেই সম্পূর্ণ নিজের মেধায় এবং ঐকান্তিক চেষ্টায় বড় হয়েছেন ডঃ গুডিভ। ঢাকার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। যখন ছয় বছর বয়স, তখনই নেমে আসে প্রথম দুর্যোগ। অনাথ হয়ে যান সূর্যকুমার। না, সেই ছোট্ট বয়সেও দমে যাননি তিনি। গ্রামের পাঠশালা থেকেই বাংলা, সংস্কৃত, পারসি— তিনটি ভাষাতেই দক্ষতা অর্জন করেন। এরপরেই তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ইংরেজি ভাষার প্রতি। আরও শিখতে হবে, পড়তে হবে— এই লক্ষ্যেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে একা চলে আসেন কুমিল্লায়। ভর্তি হন একটি ইংরেজি স্কুলে। না, ফ্রিতে ভর্তি হননি। পড়াশোনার জন্য রীতিমতো কাজ করতে হত তাঁকে, ওই বয়সেই। রাঁধুনি হিসেবেও কাজ করেছিলেন তখন।

পরবর্তীকালে কলকাতায় চলে আসেন সূর্যকুমার। ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। এরপরেই শুরু হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর ডঃ হেনরি গুডিভের কাছে শুরু করেন অ্যানাটমি শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, এটা উনবিংশ শতকের মাঝের সময়। তখনও নানা কুসংস্কারে জর্জরিত ছিল বাংলার সমাজ। সেই সময়, হিন্দুদের শবদেহ স্পর্শ করা ছিল ঘোর অপরাধ। সেইসব দূরে সরিয়ে রেখে, সরাসরি মাঠে নামলেন বামুনের ব্যাটা সূর্যকুমার। ধীরে ধীরে ডঃ গুডিভের অন্যতম প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর দক্ষতা মুগ্ধ করে তাঁকে। ডঃ গুডিভের পরামর্শেই আরও তিনজন বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে সূর্যকুমার পাড়ি দেন বিলেতে, ১৮৪৫ সালে। লক্ষ্য, ডাক্তারি শেখা। এখানেও ছকভাঙা কাজ। কারণ, তখনকার দিনে সমুদ্র পেরনো’কে ঘৃণ্য চোখে দেখা হত। সেই কালাপানি পেরনোর ধক দেখিয়েছিলেন এই চার বাঙালিই।

ইংল্যান্ড থেকেই তিনি পাশ করেন এম.বি.। ১৮৪৯ সালে সসম্মানে পাশ করেন এম.ডি.। তার আগের বছরেই তিনি রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনের সদস্যও মনোনীত হন। এই সময়ই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। সূর্যকুমার হয়ে যান সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী।

কলকাতায় ফিরে এসে তিনি যুক্ত হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে। সেখানেই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৮৫৪ সালে সেখানেই মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর হন। ডঃ সূর্যকুমার গুডিভই প্রথম ভারতীয়, যিনি মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের জায়গা ছিল অন্যত্র। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় তখনও কোনো ভারতীয়কে বসার সুযোগ দেওয়া হত না। ইচ্ছা থাকলেও, সেখানে সুযোগ পেলেন না সূর্যকুমার।

কিন্তু, সুযোগ এল অবশেষে। ১৮৫৪ সালে এই পরীক্ষার ওপর উঠে গেল নিষেধাজ্ঞা। ভারতীয়রাও পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যোগ্য হলেন। আর ছাড়লেন না সুযোগ। পরীক্ষা দিলেন সূর্যকুমার। সাল, ১৮৫৫। ভারতের ইতিহাসে, বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দিন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ডঃ সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হিসেবে। ১৮৭৩ সালে এখানেই সার্জেন মেজর পদেও উত্তীর্ণ হন তিনি।

একদিক থেকে বর্ণময় জীবন তাঁর। সেই সময় একজন আন্তর্জাতিক মুখও ছিলেন তিনি। প্রায় সমস্ত জায়গাতেই ডঃ সূর্যকুমার গুডিভকে উল্লেখ করা হয় ‘আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রথম ভারতীয় যিনি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন’। ১৮৭৪ সালে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দায়িত্ব থেকে সরেননি তিনি। একজন ডাক্তারই শুধু নয়, সেই সময়ের একজন বাঙালি সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাতেও তাঁকে দেখতে পাই আমরা। ডঃ সূর্যকুমার গুডিভের গল্প তাই বেড়া ভাঙার গল্প।

Powered by Froala Editor

More From Author See More