প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করতে নিতেন হরেক ছদ্মবেশ, এক বিস্মৃত বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিকের কাহিনি

বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর। ঢাকায় অবস্থিত এই মিউজিয়ামটি বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম শরিক। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইতিহাসকে ধরে রেখেছে এটি। বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের প্রসঙ্গ আসলেই চলে আসবে আরও একজনের কথা। তিনি না থাকলে এই যাদুঘর এবং বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাও বোধহয় পূর্ণতা পেত না। তিনি, নলিনীকান্ত ভট্টশালী।

ইতিহাস নিয়ে চিরকালের আগ্রহ তাঁর। আগ্রহ না বলে নেশা বলা ভালো। বিংশ শতকের শুরুতেও ঢাকায় কোনো মিউজিয়াম ছিল না। এদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে পূর্ব বাংলাও ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু সেগুলোকে সংরক্ষণ করার জায়গা ছিল না। ১৯১২ সালে পুরনো ঢাকার নর্থব্রুক হলে এই নিয়েই বক্তৃতা দিয়েছিলেন তরুণ নলিনীকান্ত। তাঁর বক্তৃতা মুগ্ধ করে সবাইকে। স্বয়ং ছোট লাট লর্ড কারমাইকেলও প্রশংসা করেন নলিনীর। মূলত সেই দিন থেকেই যাদুঘরের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ১৯১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায় ‘ঢাকা যাদুঘর’। ২৮ বছরের তরুণ নলিনীকান্ত’র প্রায় একক চেষ্টায় রূপ পেল এই জায়গাটি। তিনিই হলেন এখানকার প্রতিষ্ঠাতা-কিউরেটর।

শুধু যাদুঘর তৈরি করলেই তো হবে না; ঐতিহাসিক জিনিসও তো সংগ্রহ করতে হবে। সেই কাজটাও আমৃত্যু করে এসেছেন নলিনীকান্ত ভট্টশালী। যেখানেই কোনো প্রাচীন বস্তু উদ্ধারের খবর পেতেন, সেখানেই বেরিয়ে যেতেন একাই। সঙ্গে থাকত সামান্য কিছু খাবার, আর ক্যামেরা, বেতারযন্ত্র। সেই সময় চারপাশের পরিবেশ এখনকার মতো সুগম ছিল না। নানা বিপদ, শঙ্কা উপেক্ষা করে ছুটে যেতেন তিনি। ইতিহাস যে তাঁর কাছে নেশা ছিল! প্রাচীন বস্তু হাতে না আসা পর্যন্ত শান্তি পেতেন না। তারপর যত্ন নিয়ে যাদুঘরে সংরক্ষণ করতেন।

এই প্রত্ন সামগ্রী সংগ্রহ করতে গিয়ে ছদ্মবেশেরও সাহায্য নিয়েছেন অনেকবার। একবার খবর পেলেন, কোনো এক ব্রাহ্মণ পরিবারের বাড়িতে একটি প্রত্নবস্তু রয়েছে। খবর পেয়ে পাঞ্জাবী, ধবধবে সাদা ধুতি, গলায় পুঁতির মালা পরে ব্রাহ্মণবেশে সেখানে হাজির হন নলিনীকান্ত। তাঁর সেই রূপ দেখে অভিভূত হয়ে যায় সেই পরিবার। পরে তাঁদের কাছ থেকে নিয়ে আসেন সেই মূর্তি। আবার অনেক সময়, থানা বা জেলাশাসকের কাছেও জমা পড়ত উদ্ধার করা প্রাচীন মূর্তি। সেসব ক্ষেত্রে নিজেই অফিসের কেতাদুরস্ত পোশাক পরে চলে যেতেন। তখন তাঁকে বড় অফিসার মনে হত। এমনকি, জেলেদের সঙ্গে চারদিন কাটিয়েছেন শুধুমাত্র ডুবে যাওয়া প্রত্নবস্তু উদ্ধারের জন্য।

কোটালিপাড়া, দেউলবাড়ি, বড়কামতা, ময়নামতির মতো পুব বাংলার ঐতিহাসিক স্থানগুলো সামনে আসতই না, যদি নলিনীকান্ত ভট্টশালী না থাকতেন। লোককথা, ইতিহাস সমস্ত কিছু সংগ্রহ করার পেছনে তাঁর একান্ত অধ্যাবসায় ও গবেষণা অন্য অনেকের মনে আগ্রহ জাগায়। প্রত্নতত্ত্বের মানচিত্রে পূর্ব বাংলা জায়গা করে নেয়। আমৃত্যু তিনি ছিলেন ঢাকা যাদুঘরের কিউরেটর। আজ যা ‘বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর’ নামে পরিচিত। কাজ করতে করতেই ১৯৪৭-এর ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More