একজন উজ্জ্বল মানুষ। বড়ো বৃদ্ধ। চোখের ক্ষমতা কম। এমনকী কাগজের নৌকা নির্মাণের পদ্ধতিও ভুলে গেছেন। কবিতার মিল খোঁজেন। এভাবেই ‘মন্থর প্রহর’ অতিবাহিত। সন্ধ্যায় ‘‘শীতের পুরোভাগে মৃত্তিকাসংলগ্ন মেঘ এখনো কুয়াশারাশি ব’লে/ অভিহিত হয়— এই কুৎসাভীত বহু ভালোবাসা।” তিনি, বিনয় মজুমদার (Binoy Majumdar)। জীবনের বড়ো অংশ মানসিক রোগে ভুগছেন কবি। একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আটবারের বেশি তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একত্রিশ বার বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চিকিৎসা হয়েছে তাঁর। আর স্বয়ং কবি? তিনি নিজেও এই ঘটনা নিয়ে মজা করেছেন। নাকি প্রায় বলতেন— ‘আমি পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত পাগলাগারদের ইন্সপেক্টর-জেনারেল।’ এভাবেই কেটেছে কবির পুরো জীবন। যাপনে কখনো তিনি ভগ্নমনস্ক। কখনো একাকী। ভালোবাসাহীন। অসংগত। মানসিক সংযমহীন। দারিদ্র্যে বিচলিত। ক্ষুধায় যাপিত বৃক্ষদের মতো। ম্রিয়মাণ। এভাবেই তাঁর সুদীর্ঘ পথ হাঁটা। সে পথে কাঁটা। ‘রক্তাক্ত দু-পায় তোমার দুয়ারে এসে অনিশ্চিত, নির্বাক, চিন্তিত।/ তুমি কি আমাকে বক্ষে স্থান দিতে সক্ষম, মুকুর?’
এক সাংবাদিক একবার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি গায়ত্রীকে ভালোবাসতেন? বিনয়ের উত্তর ছিল, ‘না, আমরা মাত্র কয়েকবার দেখা করেছি। সে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। তারপর সে চলে গেছে। আমি নিশ্চিত নই কোথায়, তবে আমেরিকায় হতে পারে।’
—তাহলে তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখলেন কেন?
—আচ্ছা, কাউকে নিয়ে তো লিখতেই হবে, তাই না? গাছ, ফুল, মাছ নিয়ে আর কতদিন লিখতে পারা যায়!
পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। উজ্জ্বল অ্যাকাডেমিক জীবন কাটান। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন। শিবপুর কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। বড় বড় পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান তাঁকে শিক্ষকতার চাকরির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিনয় সব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি শুধু কবি হতে চেয়েছিলেন। এবং কবিতার ভুবনে অমর এই মানুষটি লেখেন ‘ফিরে এসো চাকা’ ও ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। দু’টি কাব্য প্রকৃতি এবং বৈচিত্র্যগতভাবে আলাদা। দুই কবিতাগ্রন্থই বাংলা সাহিত্যের দৃশ্যপটে তাদের অবস্থান সুরক্ষিত করেছে। কীভাবে তা হল? আওয়ার গ্রেটেস্ট ট্রুথস আর অলসো দ্য সিম্পলেস্ট। আমাদের সবচেয়ে বড় সত্যগুলো সবচেয়ে সহজও।
কেন তিনি অঘ্রাণকে বেছে নিয়েছিলেন? হয়তো জীব তার নিজস্ব সত্তা এই সময় বজায় রাখতে চায় বলে। হয়তো এই সত্তার মাধ্যমেই সৃষ্টি। রিপ্রডাকশন। এই কাব্য আসলে অমরত্বের গর্জন। অবদমনের শীৎকার। একাকিত্বের সারাৎসার। কাব্যগ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে কবি বলেছেন, ‘‘এই বিশ্ব সংসারে আমার একাকিত্বের কথা কবিতা ছ’টির উপজীব্য।” বিশ্লেষকরা বলেন, এই অবদমনের জন্মদাতা নারীসঙ্গবর্জিত একাকীত্ব। হয়তো এই কারণেই কবির উচ্চারণ, ‘‘মনে হয়, সবচেয়ে বেশি চিন্তাশীল এক অবয়ব ব’লে/ খুব বেশি পরিমাণে চিন্তা ক’রে দেয় ব’লে সমগ্র চিন্তার/ প্রায় সবই একা-একা যৌনাঙ্গই করে দেয়, ক’রে দিয়ে থাকে—/ সকল চিন্তাই তার একক একাধিপত্যে অবাক করেছে।/ যে-কোনো কাহিনী তাই শুধুমাত্র যৌনাঙ্গের আত্মকাহিনীই,/ যেকোনো চিন্তাই তাই এই চিন্তাকারীটির একক জীবনী…’ অনুভূতিগুলোকে এভাবে সাজিয়ে তুলতে সাহস লাগে।
আরও পড়ুন
বিনয় মজুমদার, মৃতদেহ ও একটি খাম
কেউ কি জানেন সবচেয়ে খারাপ ধরনের দুঃখ কেন সব সময় ব্যাখ্যা করা যায় না? কবি রেইন কুপার লিখছেন, ‘আমার বন অন্ধকার, গাছগুলি উদাসী, সকল প্রজাপতির ডানা ভাঙা।’ বিনয় লিখছেন, ‘‘হয়তো আলোর ভয়ে হয়তো বা লাজে/ পৃথিবীর কাছ থেকে, নিজের দু'চোখ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে/ রেশমের প্রজাপতি কতোকাল একা একা এখনো রয়েছে প'ড়ে রেশমের মাঝে।’’ এসব কবি দেখেন। ভাবেন, একদিন সে এই বেশ ছিঁড়ে ফেলবে। উদ্দাম খেলবে আলোর দেশে। প্রতিদিন সে লাল ফুল নীল ফুলদের মাঝে পাখা মেলবে। হাওয়ার দোলায় নাচবে। কিন্তু বহুদিন সে তার বাসা ছাড়ে না। নিজে নিজে চমকিতও হয় না। ‘অবরোধে থেকে থেকে প্রজাপতি অবশেষে মরে যায়নি তো!’ রূপকথার উত্থান অরূপকথায়। সেখানে তাঁর প্রিয় বাগানে বহু ফুল গাছ। সারাক্ষণ ফুল ফুটে থাকে। প্রজাপতিগুলি উড়ে উড়ে ফুলে ফুলে মধু খায়। ‘এ বিশ্বের প্রজাপতিসমূহ আমার এই পুষ্পদদানে আসে।/ নানান রঙের সব প্রজাপতি— সাদা, লাল, হলুদ প্রভৃতি।/ আমরা কেবল এই ফুল গাছ রোপন করেছি;/ প্রজাপতিসমূহকে কখনো ডাকিনি আমি, তবু/ এই বিশ্বের প্রজাপতিসমূহ নিজেরা যেচে এসে ফুলে মধু খায়/ আমার বাগানে।’ যেন নিসর্গে মগ্ন কবি। অথচ কোথাও গিয়ে একটা চপেটাঘাত। অহংকারী মানুষকে থাপ্পড়। ‘মানুষের আছে অহংকার— শিল্পের বাসনা/ পাখিদের আছে মুক্ত হাওয়া।/ পাখিরা মানুষদের কাজ কি করতে চায়?/ পাখিরা পদ্ধতি দ্যাখে মানুষের—/ মানুষদের বানানো ঘর বাড়ি দেবতার, মানুষদের কবরখানা চিতার আগুন।/ মানুষ কলতলায় দাঁত মাজে।/ পাখিদের সমাজে এ দাঁত-মাজা আচরণ নেই/ দাঁত-মাজা ব্যাপারটা তাই পাখির অজানা।’
আরও পড়ুন
‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও
এভাবেই মানুষের অহংকারের মাত্রাকে শূন্যে নামিয়ে বিনয় লিখে চলেন— ‘প্রত্যেকটি প্রাণীই ভাবে এই প্রাণী পৃথিবীর/ শ্রেষ্ঠতম প্রাণী/ কুকুরকে জিজ্ঞাসা করো— পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ প্রাণী কারা?/ কুকুর জবাব দেবে— কুকুরই তো সর্বশ্রেষ্ঠ।/ বিড়ালকে জিজ্ঞাসা করো— পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী কারা?/ বিড়াল জবাব দেবে বিড়ালই তো সর্বশ্রেষ্ঠ।/ বিড়াল দেখিয়ে দেবে শীতকালে শীতবস্ত্র/ লাগে না বিড়ালদের আর/ কুকুর দেখিয়ে দেবে খাদ্যসংগ্রহের জন্য/ হাল চষা লাগে না তাদের।/ সব কুকুরের মতে শ্রেষ্ঠ প্রাণী কুকুর এবং/ সব মহিষের মতে শ্রেষ্ঠ প্রাণী মহিষ এবং/ সমস্ত পশুর মতে মানুষেরা পশু!’ এভাবেই ‘অরূপকথাগামী’ হয়েছেন বিনয় মজুমদার। এই পথের আধারে ধীরে ধীরে ভুলেছেন শহর। কলকাতা। কফি হাউস। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে নদী, মেঠো পথ, ডোবা, পুকুর, শ্মশানের পাশের খেজুর গাছ, গোলদিঘির রাজহাঁস, নিশাভিসারী কোকিল, জ্যোতির্ময় জোনাকি, কুমরে পোকা, মৌমাছি, ফল পেকে এলে প্রথম বোঝা পাখিরা। ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্টিই যেন সমতার নিখুঁত অঙ্ক। এরই সমীকরণ মিলিয়েছেন বিনয়।
Powered by Froala Editor