একজন কবি কেন বারংবার নিজেকে ভাঙেন? কেনই বা অজস্রবার লেখা ও সংশোধনের পরেও দ্বন্দ্ব কাটে না তাঁর? নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হওয়ার চেষ্টা – এ-কথা সবাই বলবেন একবাক্যে। কবিতা লেখার সময় ও লেখার পরও, অজস্র এডিটিং-এর মধ্যে দিয়ে যান একেকজন কবি। এমনকি, কোনো পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পরও, বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করার সময় শিরোনাম বদলেছেন – এমন উদাহরণও কম নেই। কিন্তু একই বইয়ের নাম বারবার বদল করা? নাহ্, বাংলা সাহিত্যে এমন উদাহরণ আমার অন্তত জানা নেই। কিন্তু কেনই বা একজন কবি এমনটা করবেন? নামের মধ্যে দিয়ে উদ্দেশ্য ও মনোভাব আরও স্পষ্ট করে তোলার জন্য? এ-ছাড়া আর কারণ কীই বা হতে পারে? সচরাচর কোনো বই একবার প্রকাশিত হয়ে গেলে, পরবর্তী সংস্করণে সে-বইয়ের নাম বদলাবার সাহস দেখান না কেউই। ব্যতিক্রম বিনয় মজুমদার।
আরও পড়ুন
'বকুনি খেলেই কাঁদে', তবু তরুণী স্ত্রী'র বিরহ সহ্য হত না বিভূতিভূষণের
হ্যাঁ, বিনয় পেরেছিলেন। একবার নয়, একই বইয়ের নাম বদলেছিলেন পরপর তিনবার। আর সেই বইটি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই। সচেতন পাঠক সে-বইয়ের সঙ্গে পরিচিত। ‘ফিরে এসো চাকা।’
শুধু আমার কথা ভাবলে কাব্যখানি কেবল প্রেমার্তির
১৯৬১ সালের মার্চ মাসে, প্রকাশিত হয় ‘গায়ত্রীকে।’ বই না বলে একে পুস্তিকা বলাই ভালো। মাত্র ১৩টি কবিতা ছিল এই পুস্তিকায়। পরের বছরই, ১৯৬২-র সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ বইটি। ‘গায়ত্রীকে’ প্রকৃতপক্ষে ‘ফিরে এসো চাকা’র প্রথম সংস্করণ। প্রথম পুস্তিকাটিতে যে কবিতাগুলি ছিল, সেগুলির কিছু পরিমার্জনা করে, কিছু সরাসরিই পরবর্তী বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন কবি। কিছু বাদও দিয়েছেন। পাশাপাশি, যোগ করেছেন অনেকগুলি নতুন কবিতাও। এর ফলে, ‘ফিরে এসো চাকা’য় কবিতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৭। উৎসর্গ – ‘শ্রীমতী গায়ত্রী চক্রবর্তীকে।’
এ-পর্যন্ত তাও না হয় স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া গেল সবকিছু। ‘গায়ত্রীকে’ পুস্তিকাটির পরিবর্ধিত সংস্করণ পরবর্তী বইটি, এমনকি প্রায় নতুন বই-ই বলা চলে, অতএব নামবদল সঙ্গত। অথচ তার বছর দুয়েকের মধ্যেই আবার চমক।
বিনয় ততদিনে ২৮ থেকে ৩০ বছরের। ‘ফিরে এসো চাকা’র সমালোচনায় ভালো-মন্দ উভয় প্রতিক্রিয়াই জুটেছে। সাধারণত অন্যান্যরা একটি বই প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পর, সেটিকে অতিক্রম করে পরবর্তী বইয়ের দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু বিনয়, দু’বছরের মধ্যেই আবার নাম বদলালেন। ‘ফিরে এসো চাকা’ এবার হল ‘আমার ঈশ্বরীকে’।
‘আমার ঈশ্বরীকে’-র প্রকাশ ১৯৬৪ সালের জুনে। এই বইটি ‘গায়ত্রীকে’-র তৃতীয় সংস্করণ, এমনটা জানিয়েছেন বিনয় নিজেই। প্রথম দুটি বইয়ের প্রকাশক ‘গ্রন্থজগত’-এর দেবকুমার বসু হলেও, ‘আমার ঈশ্বরীকে’ বইটিতে প্রকাশক হিসেবে নাম স্বয়ং কবিরই। এই বইয়ে আবার পরিমার্জনা। ‘ফিরে এসো চাকা’-র থেকে চারটি কবিতা বাদ দিলেন তিনি। যোগ করলেন নতুন ছ’টি। মোট কবিতার সংখ্যা হল ৭৯। পরের বছর, ১৯৬৫ সালে বিনয়ের কাব্যগ্রন্থ সংকলন ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’-তে ‘গায়ত্রীকে’ কিংবা ‘ফিরে এসো চাকা’ ঠাঁই তো পেলই না, বরং হুবহু অন্তর্ভুক্ত হল ‘আমার ঈশ্বরীকে’ বইটি। প্রসঙ্গত, এই সংকলনের প্রকাশক বিনয় নিজে নন, দেবকুমার বসু।
যে-কোনো পাঠক কিংবা পাঠিকার নিজেরই জীবনের কোনো পরিস্থিতির বিশ্লিষ্ট রূপায়ণ ব’লে মনে হবার কথা
‘আমার ঈশ্বরীকে’ বইটিতে একটি অসামান্য ভূমিকা লিখেছিলেন কবি। এটি ‘ফিরে এসো চাকা’র কোনো সংকলনেই অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিনয়প্রেমী পাঠকদের জন্য রইল সম্পূর্ণ ভূমিকাটি –
‘একজন বান্ধবীকেন্দ্রিক শুধুমাত্র প্রেমার্তির এই কাব্যখানি যথাযথ দিনপঞ্জী বিশেষ। তবে বিশেষ এবং সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রচনা করার ফলে কাব্যের অন্তর্গত সংখ্যাত প্রতিটি অংশ যে-কোনো পাঠক কিংবা পাঠিকার নিজেরই জীবনের কোনো পরিস্থিতির বিশ্লিষ্ট রূপায়ণ ব’লে মনে হবার কথা। সেই উদ্দেশ্য মনে রেখেই প্রতিটি সংখ্যাত অংশ রচনা করা হয়েছে।
আবার যেহেতু যে-কোনো একটিমাত্র অংশই প্রেম, সমাজনীতি, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের সঙ্গে বিজড়িত পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য সেহেতু যে-কোনো পাঠক কিম্বা পাঠিকার জীবনের যে-কোনো পরিস্থিতিরই সফল রূপায়ণ এ-কাব্যে খুঁজে পাবার কথা।
আমরা যে-মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে স্বপ্ন দেখি (দৃশ্যের পর দৃশ্যের সমন্বয়ে), সেই পদ্ধতিতে কাব্যখানি এবং কাব্যের অন্তর্গত প্রত্যেক সংখ্যাত অংশ রচনা করা হয়েছে।
প্রত্যেক সংখ্যাত অংশই এক-একটি স্বয়ং-সম্পূর্ণ কবিতা। এবং কালানুক্রমে দিনপঞ্জীরূপে লিখিত কবিতাবলী একযোগে একখানি পূর্ণ কাব্যও। অর্থাৎ যে-কোনো সংখ্যাত অংশই পৃথকভাবে হ্রস্ব কবিতারূপে বিবেচিত অবস্থায় পাঠ করাও সম্ভব।
শুধু আমার কথা ভাবলে কাব্যখানি কেবল প্রেমার্তির, অন্যদের বিষয় ভাবলে যে-কোনো প্রয়োজননির্বাচিত বিষয়ের।
এ-সংস্করণে সর্বমোট ৭৯টি কবিতা আছে, এবং কবিতার সংখ্যা আর বাড়ানো হবে না। কাব্যের নামও আর পরিবর্তিত করা হবে না।’
বিনয় কেন এই ভূমিকা লিখতে গেলেন, রচনাপদ্ধতির ব্যাখ্যা দেওয়ারই বা দরকার কী পড়ল, আদৌ এই জ্যামিতিক পদ্ধতিতে কবিতা লেখা(যা বিনয় একাধিক জায়গায় জানিয়েছেন) কতটা যুক্তিযুক্ত – এসব আলোচনার পরিসর এখানে নেই। ভূমিকাটির আসল স্পন্দন লুকিয়ে আছে একটি বাক্যাংশে – ‘শুধু আমার কথা ভাবলে কাব্যখানি কেবল প্রেমার্তির’।
এই নামবদলের খেলার শেষ কিন্তু এখানেই নয়। ১৯৭০ সালে আবার প্রকাশিত হয় বইটি, এবার নাম ‘ফিরে এসো চাকা।’ এতে অনুসরণ করা হয়েছে প্রথম ‘ফিরে এসো চাকা’ বইটিকেই। অবশ্য এরপর থেকে বিভিন্ন সংস্করণ বিনয়ের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হলেও নাম আর বদলায়নি, ‘ফিরে এসো চাকা’তেই থিতু হয়েছিল শেষ অবধি।
সব শেষে, একটা সাধারণ প্রশ্ন পাঠকমনে উঁকি দিয়েই যায়। ‘গায়ত্রীকে’ থেকে ‘ফিরে এসো চাকা’, তারপর ‘আমার ঈশ্বরীকে’ – প্রেমার্তি প্রকাশের জন্যেই কি বারবার এই বদল? সমর্পণ যে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে প্রত্যেকটা নামে, তাতে সন্দেহ নেই। পাঠকের কাছে তাঁর এই সমর্পিত হৃদয়ের খবরই কি বারবার পৌঁছে দিতে চাইছিলেন বিনয়? তাই এত নামবদল?
কিন্তু সেই সমর্পণ কতটা সত্যি আর কতটা আরোপিত? পরবর্তীকালে বিনয় নিজেই বলেছিলেন, গায়ত্রীকে কফি হাউসে দু’একবার দেখেছেন মাত্র। প্রেম তো দূরের কথা, কথাও হয়নি কোনোদিন। কাউকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখতে হয়, তাই তৎকালীন প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্রী গায়ত্রী চক্রবর্তীকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। গায়ত্রী যখন ‘গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তী’, তিনিও জানিয়েছেন, বিনয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল না কোনো। তাহলে কি বিনয়ের এই সমর্পণের পুরোটাই পরিকল্পিত? তাঁর জ্যামিতিক ছকে বাঁধা কবিতার মতোই?
পাঠকমন কিন্তু তা বিশ্বাস করতে চায় না। সব জেনেও বিনয়কে চিরকালীন বিরহী কবির জায়গাতেই দেখতে চায় সে। যাকে ভালোবাসতেন, তাঁকে না-পাওয়ার যন্ত্রণা থেকেই লেখা ‘ফিরে এসো চাকা’র কবিতাগুলি – এই বিশ্বাসের মধ্যে যে শান্তি আছে, তা আর কোনো টিকা-টিপ্পনী-সমালোচনাতেই নেই।
লেখার মধ্যে প্রবেশ করে, গায়ত্রীকে কি ভালোবাসেননি বিনয়? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। নিজে সেই প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা অনুভব না করলে এমন কবিতা লিখতে পারতেন না। শুধু ছকে বেঁধে যে এই উচ্চতা ছোঁয়া যায় না, তা আশা করি প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন।
দীর্ঘদিন পর, বৃদ্ধ বয়সে গায়ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বিনয় আবার লিখলেন, ‘আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো/...আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,/তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,/চিঠি লিখব না।/আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।’ সেই সঙ্গে, সারাজীবন তাঁর একা থেকে যাওয়াও। এ-যদি হাহাকার ও বিরহের শান্ত বহিঃপ্রকাশ না হয়, তাহলে বিরহ কী?
Powered by Froala Editor