বিনয় মজুমদার, মৃতদেহ ও একটি খাম

গণিতের রস উপভোগ করার সাধ্য আমার নেই। স্কুল ফুরোলে কলেজে কয়েক সেমিস্টার বাধ্যতামূলক ভাবে কষতে হয়েছিল, তারপরই যাবতীয় সম্পর্কের ইতি। তবুও, কখনও-কখনও, আশ্চর্য সব কবিতা নিয়ে হাজির হয় গণিত। যেমন বিনয়ের এই ভাবনাসূত্রে। মৃতদেহ গুণ রুট মাইনাস ওয়ান। এখানে রুট মাইনাস ওয়ানের অর্থ জানা না থাকলে সম্পূর্ণ বুঝে ওঠা অসম্ভব। ফলে, দীর্ঘদিন পরে আবার ফিরতে হল গণিতের কাছে। কী বলতে চাইছেন বিনয়?

রুট মাইনাস ওয়ান আদতে একটি ইউনিট ইমাজিনারি নাম্বার। যাকে 'i' দিয়ে পরিচয় করানো হয়। আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য 'অনন্ত'ই ধরে নিই বরং। ইনফিনিটি হলেই অনন্তের সঙ্গে সুবিচার হত। অথচ এই যে ইমাজিনারি নাম্বার, যার আড়ালে 'ইমাজিন' শব্দটি লুকিয়ে  সেই কল্পনারও কি সীমা হয় কোনো?

'অনন্ত' শব্দটার যে বিস্তৃতি, তা দিগন্তেরও কয়েকগুণ। মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া আলোকরশ্মির মতো। মৃতদেহের সঙ্গে সেই অনন্তকেই গুণ করছেন বিনয়। শুরু খুঁজে পাচ্ছেন মৃতের পদতল থেকে। চোখে ভেসে ওঠল শ্মশানে শোয়ানো কোনো মৃতদেহ। চিতায় উঠতে খানিক দেরি আছে তখনও। বাদবাকি আচার পালিত হচ্ছে। প্রদক্ষিণ, পিণ্ড ছোঁয়ানো, মুখাগ্নি ইত্যাদি ইত্যাদি। নির্বিকার মৃতদেহ শুয়ে আছে নিজের মতো। সবাই এসে একে একে প্রণাম করে যাচ্ছে পা ছুঁয়ে। অথচ জানতে পারছে না, সেই দক্ষিণমুখী পা থেকেই অনন্তের শুরু। উবে যেতে শুরু করে পায়ের প্রত্যেক রেখা। জাগতিক গণ্ডি পেরিয়ে মহাবিশ্বে তরঙ্গ হয়ে ভেসে বেড়ায় সেইসব রেখা। আমরা রাডারে কিছু ধরতে পারি। বেশিরভাগই পারি না। রুটের নিচে, জটিলতর কোনো সংখ্যা হয়েই থেকে যাই আজীবন। 

‘চিৎ হয়ে শোয়ানো মৃতদেহ’। হয়ে, করে নয়। যেন মৃত নিজের ইচ্ছাতেই শুয়েছেন চিৎ হয়ে। চোখ বন্ধ, ওপরের দিকে মুখ। মুখ থেকে পা— সর্বত্রই অনন্ত খুঁজে যাচ্ছেন সেই মৃত। তাঁর দেহের সঙ্গে গুণ করা হচ্ছে রুট মাইনাস ওয়ান। প্রাণ ফিরে এল কি? সঙ্গে সঙ্গে এতদিনকার তুচ্ছ অস্তিত্ব ছিঁড়ে ‘মহাগ্রন্থ’ হয়ে উঠল তাঁর জীবন? সেই গ্রন্থই নথিভুক্ত করে রাখতে বলছেন বিনয়? 

কেমন নথিভুক্তি? নিজের পাণ্ডুলিপি বিলেতের একটি ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছিলেন তিনি সংরক্ষণের জন্য। অথচ মৃত মানুষ যখন মহাগ্রন্থ হয়ে ওঠেন, পৃথিবীর কোনো লাইব্রেরি ধরতে পারে না তাঁকে। জায়গা খুঁজতে হয় গ্রহে, নক্ষত্রে। তারই নিদান দিচ্ছেন বিনয়। ধরিত্রী/পৃথিবী/অশ্বিনী/মঘা। এই-এই ঠিকানাই হতে পারে মৃত্যু-পরবর্তী বিচরণক্ষেত্র। 

ইংরাজিতে লেখা ‘রেকর্ড’ শব্দটি, বড়ো হাতের অক্ষরে, দেখে মনে পড়ছে আরেক রেকর্ডের কথা। একদিকে শ্মশানে শোয়ানো মৃতদেহ, অন্যদিকে লাগোয়া সরকারি অফিসে দৌড়ঝাঁপ করছেন আত্মীয়স্বজন। কেন? ‘মৃত’ হিসেবে রেকর্ড করাতে। যে মানুষটি এতদিন জীবিত ছিলেন, আজ যে তিনি মৃত— সরকারি সিলমোহর ছাড়া যেন সেই মৃত্যুও সত্য হয়ে ওঠে না। সরকারি কাগজপত্রই তাহলে কি সেই মহাগ্রন্থ? যার পিছনে ছুটতে ছুটতে কেটে যায় অনন্ত সময়? ‘সর্বত্র রেকর্ড রাখুন’— শ্মশানে, পৌরসভায়, ব্যাঙ্কে, না জানি আরও কোথায়-কোথায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই ঠিকানাগুলিই তো ধরিত্রী, পৃথিবী, অশ্বিনী, মঘা। ‘রেকর্ড’ শব্দটি হতে পারত গ্রামাফোনের কালো চাকতিও। জীবনের সুর জমিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর। মৃত্যুর পর, ঘুরে-ঘুরে বাজতে থাকে গ্রহে-নক্ষত্রে। দৈবী অনুরণন? 

সমগ্র মৃত্যুদর্শনটির সঙ্গে নিজেকে একটি রেখা দিয়ে আলাদা করেছেন বিনয়। যেন বলতে চাইছেন, এ-কথা আমার না হয়েও আমারই। একদিন আমিও রুট মাইনাস ওয়ান হব, ছড়িয়ে পড়ব সর্বত্র। আপাতত এই বিভেদরেখাটুকু থাক। কিংবা, কে জানে, হয়তো ওই দুর্বল রেখা দিয়েই মৃত্যুকে ঠেকাতে চাইছেন তিনি। বাঁচতে চাইছেন। চিরন্তন কাব্য হয়ে আসার অপেক্ষা ফুরোয়নি তাহলে?

মাথায়, ছাপা অক্ষরে, ‘গঙ্গা’। সাধারণত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে দেখা যায়। বিনয়ের এই ভাবনাসূত্রের উৎসও তেমনই এক নিমন্ত্রণপত্র। সেটা ২০০৪ সাল। বিনয়ের মৃত্যুর বছর দুয়েক দেরি তখনও। শিমুলপুরের জনৈক সুহৃদের মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন বিনয়। সেই নিমন্ত্রণপত্রের খামের ওপরেই লেখা ভাবনাসূত্রগুলি। বিনয়ের মৃত্যুর পর, ২০০৭ সালে, ‘উদ্ভেদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই খামের ছবি। আমারও নাগাল পাওয়া সেখান থেকেই।

একটি নিমন্ত্রণপত্রের খামকে নিজের ভাবনা দিয়ে অক্ষয় করে গিয়েছেন বিনয়। গঙ্গা-র নিচে যে শোয়ানো মৃতদেহ, দাহের পর মিশে গিয়েছিল গঙ্গাতেই। নাকি অন্য কোনো নদী— ইছামতী? তা আমরা জানি না। শুধু আন্দাজ করতে পারি, চুপটি করে বসে থাকা মাইনাস ওয়ান আসলে আমাদেরই ব্যর্থ জীবন। মাথার ওপর আশ্রয় জুটলে, স্নেহ ও ভালোবাসার রুটচিহ্ন এসে ছায়া দিলে, তবেই অনন্তের স্বাদ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে হোক বা পরে— মহাগ্রন্থ হতে আর বাধা নেই তখন।

Powered by Froala Editor