এমনকি, প্রতিমার চোখেও বিষাদ দেখেছিলাম সেদিন। যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি, জলের ছোঁয়ায় গলে গেছে তাঁর সিঁদুর, দেখেছিলাম তাঁর করুণ মুখ। মানুষের দুর্বলতম অংশ বোধহয় চোখের কোল। বানভাসি হয়, আবার ক্লান্তিতে বসেও যায়। দেবীরও কি তাই? নইলে সব ছেড়ে কেন ঠিক চোখের নিচের রংটাই উঠে যাবে? যেন প্রথম যাচ্ছেন শ্বশুরবাড়িতে। এতদিনের আবাস ছেড়ে যাওয়ার আগে, উথালপাথাল কান্নার চিহ্ন তাঁর চোখেমুখে। কষ্ট পান তিনিও। কোথাও হয়তো তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছি বলেই, নিজেদের কষ্টটা বড় হয়ে ওঠে এইসব দিনে।
এমনই এক বিসর্জনের দিন আমায় একজন বলেছিল, ‘তোরা এই দৃশ্য দেখতে আসিস! এই যে ভাসানের আগে পাড়ে বসিয়ে রাখা হচ্ছে প্রতিমা, তারপর তাঁকে কয়েকজন ধরে ফেলে দিল জলে, একবারও ভেবেছিস, প্রতিমার কেমন লাগে? পাড়ের সেই শেষ মুহূর্তে বুকটা কেমন দুরুদুরু করে তাঁর?’ উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। সত্যিই তো, তিনি যে যেতেই চান, তা তো নাও হতে পারে! নইলে ডুবে যাওয়ার সময় অমন বিষণ্ণ হবেন কেন? জলে ডুবে আকাশে পৌঁছনো যায় বুঝি?
ওই যে ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে পাড় থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে জলে, খুলে নিচ্ছে প্রতিমার মুকুট, গহনা – আজ ওর আনন্দের দিন। রাংতা-পরানো ওই মুকুট বেচে ঘরে আসবে দুটো টাকা। যে ছেলেগুলো দড়ির মাথায় চুম্বক বেঁধে ডুবিয়ে দিচ্ছে জলে, আনন্দ তাদেরও। এই সুযোগে কিছু খুচরো পাওয়া যাবে। আনন্দ নেই মাঝবয়সী লোকটার। সাঁতরে সাঁতরে কাঠামো জড়ো করছে এককোণে। আবার ফিরে আসছে। আবার কাঠামো। এই যাতায়াতের মধ্যেই মাঝেমাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে। পাড়ে রাখা গামছা দিয়ে মুছে নিচ্ছে মুখ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে, একটা আলো-উপচানো স্টিমারে চেপে দুর্গা চলেছেন দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে। এভাবেই কি কৈলাস পৌঁছে যাবেন দেবী? জলে ডুব দিতে হবে না আর? পরের কাঠামোর দিকে যেতে যেতে, লোকটা ভাবছে।
পাড়ে তখন হুল্লোড়। মাইকের আওয়াজ, ঢাকের শব্দ আর মানুষের উল্লাসধ্বনি মিলেমিশে এক। কোনো কোনো উল্লাসের মধ্যেও মিশে থাকে দুঃখ। দীর্ঘ অপেক্ষার পর, সে এসেছিল। ছুটি কাটিয়ে, চলেও যাচ্ছে আবার। এই আসা যাওয়ার মধ্যিখানের দিনগুলোই স্মৃতি হয়ে থাকে। নদীর বুকে বুড়বুড়ি কাটে এসব দিন। অন্য সময়ে, নদীর কাছে ফিরে এলে, মনে পড়ে সেসব।
দশমীর কিছুদিন পর, শহরের এক অনালোচিত ঘাটে দেখেছিলাম তেমনই এক দৃশ্য। সিঁড়ি ঘেঁষে, নদীর এককোণে জমে আছে তিন-চারটে কাঠামো। কচুরিপানা এসে ভিড় করেছে তাতে। আর সেই কাঠামোর পাশেই ভাসছে একটি মৃতদেহ। কার, জানা নেই। কোত্থেকে ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে এই ঘাটে, তাও অজানা। শুধু, মৃত লোকটির ওই ভেসে থাকা দেখে আমার মনে পড়েছিল বিজয়ার দিন। দেবীকে জলে ভাসিয়ে তুলে নেওয়া হয়। লোকটিকে তোলার কেউ নেই। পুলিশ এসে তুললেও, আসছে বছর আর ফিরবে না লোকটি।
এমনই হয়। কেউ কেউ ফেরে। সবাই ফেরে না। কোথাও-না-কোথাও কোনো ফাঁক গলে চলে যায় ঠিকই। পৃথিবী থেকে, জীবন থেকে। যারা ফিরে আসে, তাদের নিয়েই ঘর-সংসার। এভাবে কমতে কমতে একলা হওয়ার ক্যালেন্ডার যদি দশমী থেকেই শুরু হয়, ক্ষতি কী! অন্তত মনে থেকে যায়। শূন্য দিনগুলোকে শূন্যতর লাগে না আর তখন...