'বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে...'
শান্তিপুরি শাড়ির পাড়ে গান লিখলেন তাঁতিরা। বিদ্যাসাগরের জয়জয়কার হল। আবার অনেকে তাঁর নিন্দে-মন্দও শুরু করলেন। বন্ধুর চাইতে শত্রু বেশি কলকাতায়। আবার, কর্মাটাঁড়ে সাঁওতাল মানুষের কাছে এই ‘বিদ্যেসাগর’-ই সবচেয়ে কাছের বন্ধু। দুর্ভিক্ষের দিনে নিজের গ্রামে নিজের চেষ্টাতেই অন্নসত্র স্থাপন। আর দিনরাত এক-করে খাদ্য বিতরণ। একই সঙ্গে চলছে বই লেখার কাজ। পাঠ্যপুস্তক রচনা। অধ্যাপনা। নারীশিক্ষার প্রচলন। স্কুল নির্মাণ। বিধবাবিবাহের পক্ষে সওয়াল ও সবরকম বাধাকে নির্বিকারে টপকে যাওয়া। ভাবতে অবাক লাগে, একপ্রকার অভিমান থেকেই কলকাতা ছেড়ে চলে কর্মাটারে যাওয়ার পরেও মানুষটা প্রতিনিয়ত, প্রতিটা মুহূর্তে গড়ে চলেছেন। ক্লান্তিহীন...
একজন আদ্যন্ত কর্মী মানুষের জীবন। নিজের জাতির প্রতি এক সুগভীর দায়বোধ। সেই বোধে জারিত হয়ে নিরলস কাজ করে যাওয়া। একজন ব্যক্তি-মানুষের চেষ্টা যে কতদূর ফলপ্রদ হতে পারে, তার প্রমাণ বিদ্যাসাগর। ধর্মবিশ্বাসে ছিলেন একেশ্বরবাদী। কোনোদিন প্রতিমাপুজো করেননি। অবতারবাদে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। কাজের থেকে বড়ো করে আর কিছুকেই তিনি দেখেননি। আর সেই কাজ ছিল একটা গোটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে আসার। জাতির ধারণাটিও তাঁর কাছে বেশ বড়োই ছিল। তাই সাঁওতাল মানুষের সঙ্গে তাদের মতো করে মিশে যেতে পেরেছিলেন। তাদের জোর করে ‘মূল স্রোত’-এ আনার চেষ্টাও করেননি কখনও।
একটা মানুষ যেন একার কাঁধে সময়কে টেনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। বাঙালির আলস্যের অপবাদ ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছেন। সুখের জীবন তাঁর পোষায় না। তাই স্থিতাবস্থার বিপরীতে লড়াই করেছেন নারীশিক্ষার পক্ষে, বিধবাবিবাহের পক্ষে, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে। সংস্কৃত কলেজে বিজ্ঞানের পাঠ চালু করার জন্যেও তক্ক জুড়েছেন। এহেন মানুষকে হজম করা কঠিন। সে-যুগেও অনেকে পারেনি। কদিন আগে যেমন তাঁর মূর্তির ওপর আক্রমণ হল, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল মাটিতে, সেই আক্রমণ মোটেও কাকতালীয় নয়। বিদ্যাসাগর মানুষটা সত্যিই খুব সমস্যার, তাঁর স্মৃতি, এমনকি মূর্তিও সমস্যার। ধর্মীয় অন্ধত্ব, সামাজিক নানা অন্ধকারকে তিনি চ্যালেঞ্জ জানান বারবার। তাই তাঁর মূর্তি ভাঙতে হয়, তাই জীবদ্দশাতেও তাঁর ওপর আক্রমণ হয়।
শুনে অবাক লাগতে পারে, সেদিন যে বিদ্যাসাগর কলেজে তাঁর মূর্তি ভেঙে ফেলা হল, ১৮৫৫ সালে প্রায় একই জায়গায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে। শীতের অন্ধকার রাতে হিন্দুধর্মের ভাড়াটে গুন্ডারা ঘিরে ধরেছিল বিদ্যাসাগরকে। যে মানুষটা হিন্দুধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে, তাঁকে তো শিক্ষা দিতেই হবে। কিন্তু সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, বহুদিনের পুরোনো দেহরক্ষী শ্রীমন্তর জন্যে। আর তারপর আরো জোরকদমে প্রস্তুত হলেন, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে। সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরি তন্নতন্ন করে খুঁজে যুক্তি সাজালেন বিধবাবিবাহের পক্ষে। অবশেষে জিতলেনও। আইন পাশ হল। সমাজেও ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠতে লাগল বিধবা বিবাহ। এক ধাক্কায় যেন কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন গোটা জাতিকে।
মানুষটার জেদ ছিল দেখার মতো। বিধবাবিবাহের পক্ষে যত দৃঢ়ভাবে দাঁড়াচ্ছেন, ততই উত্তপ্ত হচ্ছে শহর। রাজা রাধাকান্ত দেবের মতো গণমান্যরাও তাঁর বিপরীতে। তাঁকে নিয়ে কটূক্তি করে ছড়া কাটা হচ্ছে। আর, তিনি আরও লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আইনি পথে জিতছেন, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিধবা বিবাহও দিচ্ছেন। সেই বিয়ে দেখতে ভিড় উপচে পড়েছে ১২ নম্বর সুকেশ স্ট্রিটের বাড়িতে।
এসবের পাশাপাশি মানুষটা বাংলা গদ্যের ছাঁদ গড়ে দিয়েছেন। নারীশিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন। স্কুল-কলেজ গড়েছেন। যেখানে তাঁর মূর্তি ভাঙা হল, সেই বিদ্যাসাগর কলেজের জন্মও তাঁরই হাতে। জন্মকালে নাম ছিল মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন। গোটা দেশে এই কলেজেই প্রথম চালু হল বাণিজ্যবিভাগের পাঠ। বিদ্যাসাগর জানতেন, শুধু কেরানি হয়ে থাকলে বাঙালির চলবে না। দেশ গড়তে হলে প্রয়োজন বাণিজ্য-উদ্যোগেরও। আর তার জন্যেও পড়াশোনা প্রয়োজন। সেই কলেজের সমস্ত শিক্ষক ছিলেন ভারতীয়। সম্পূর্ণ দেশীয় বাতাবরণে, বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এবং সেই প্রতিষ্ঠান ছিল অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ। সাধে কী আর, ধর্মের ধ্বজাধারীদের চক্ষুশূল ছিলেন মানুষটা!
ছিলেন বলছি কেন! কদিন আগেই যে তাঁর মূর্তি ভাঙা পড়ল, সে কি সত্যিই ভুলবশত? আসলে বাংলার আধুনিকতা, সম্মিলন, ধর্ম নিরপেক্ষতার ইতিহাসকে বদলে দিতে চাইলে সামনে পথরোধ করে দাঁড়ান বিদ্যাসাগর। স্মৃতিকে তো ভাঙা যায় না, তাই অগত্যা মূর্তিকেই...