হিন্দি ভাষা ও তার প্রয়োগ নিয়ে চর্চা এখন চারদিকে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সারা ভারতে এক ভাষা চালু করার নীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন অনেকেই। বলা বাহুল্য, কেন্দ্রীয় সরকারের সুপ্ত ইচ্ছে ভারতে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার। অথচ ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। সংবিধান অনুযায়ী ভারতে মোট যে ছ’টি সরকারি ভাষা রয়েছে, তাতে হিন্দির পাশাপাশি সমান অধিকার বাংলারও। হ্যাঁ, সারা ভারতে হিন্দিভাষীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা – এই পরিসংখ্যানও ভুলে যাওয়ার নয়। তবে বাংলা ভাষাতেও বর্তমানে থাবা বসাচ্ছে হিন্দি। এমনকি, শহর কলকাতাতেও, হিন্দির আগ্রাসনে অনেক জায়গায় কোণঠাসা বাঙালিরা।
কিন্তু উনিশ শতকে হিন্দির প্রভাব আজকের মতো ছিল না। সে-সময় হিন্দির পাশাপাশি ফার্সি, উর্দুও সমান গুরুত্ব পেত। আর হিন্দি ভাষাকে সবার মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনাও ছিল না তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মনে। তবে হ্যাঁ, কাজের সূত্রে কলকাতাতেও হিন্দি শিখতে হত অনেক বাঙালিকেই। আর সেই অনেকেরই একজন ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি ব্যক্তিত্ব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
১৮৪১ সাল। মাসিক ৫০ টাকা বেতনে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হলেন বিদ্যাসাগর। তখন ওই কলেজের সেক্রেটারি ছিলেন মিঃ টি এস মার্শাল। তাঁর চেষ্টাতেই জীবনের প্রথম চাকরিটি পান বিদ্যাসাগর।
তখন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কেবলমাত্র ইংরাজরাই বসতে পারতেন। তাঁরা ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি শিখতেন। তারপর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, বিভিন্ন জেলায় নিযুক্ত হতেন বিচারকার্যের জন্য। প্রথমবারের পরীক্ষায় ফেল করলে আরেকবার সুযোগ দেওয়া হত সাহেবদের। দ্বিতীয়বারও ফেল করলে, ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না তাঁদের জন্য।
এই পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা হত প্রতি মাসেই। তাঁদের খাতা দেখার দায়িত্ব পড়েছিল বিদ্যাসাগরের ওপর। অথচ তখন সংস্কৃত শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও, হিন্দি ও ইংরাজি বিশেষ জানতেন না বিদ্যাসাগর। অগত্যা মার্শাল সাহেব তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হিন্দি ও ইংরাজি শেখার জন্য।
সেক্রেটারির আদেশে বিদ্যাসাগর শুরু করলেন হিন্দি শেখা। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে, বেলা ন’টা পর্যন্ত এক হিন্দুস্থানি পণ্ডিতের কাছে হিন্দি শিখতে লাগলেন তিনি। সেই পণ্ডিতের বেতন ছিল মাসে ১০ টাকা। কয়েক মাসেই হিন্দি আয়ত্তে আনেন বিদ্যাসাগর। অন্তত পরীক্ষার খাতা দেখার মতো হিন্দি তিনি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন ওই ‘প্রাইভেট টিউশনি’ পড়েই। একইভাবে, অন্য কয়েকজনের কাছে ইংরাজিও শিখে নিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, শুনে বিবেকানন্দ-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত বিদ্যাসাগরের
পরবর্তীকালে, হিন্দি থেকে বাংলা বই অনুবাদও করেছিলেন বিদ্যাসাগর। নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই মার্শাল সাহেবই। বিদ্যাসাগরের লেখা বিখ্যাত ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ আসলে একটি হিন্দি বইয়ের অনুবাদ। সে-সময় ভালো বাংলা বইয়ের অভাব থাকায়, মার্শাল সাহেবই পরামর্শ দেন বেতাল পঞ্চবিংশতি অনুবাদের। সেইমতো হিন্দি ‘বৈতাল পঁচিসী’ থেকে বাংলায় বেতাল পঞ্চবিংশতি অনুবাদ করেন। বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত বই ছিল এটিই।
তবে হিন্দি তাঁকে গ্রাস করেনি। দরকারও ছিল না। কাজের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু হিন্দিই শিখেছিলেন তিনি। বাকি জীবন কেটে গেছে সংস্কৃত, বাংলা আর ইংরাজি নিয়েই। সব ভাষাকে সম্মান করেও, নিজের মাতৃভাষাতেই শ্বাস নিয়েছেন শেষ দিন পর্যন্ত। আজকের দিন হলে কী করতেন বিদ্যাসাগর? হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কি গর্জে উঠত না তাঁর কণ্ঠ ও কলম? তাঁকে চিনলে, জানলে, উত্তর একটাই হতে পারে – ‘হ্যাঁ’।
আধুনিক বাঙালি কি ভেবে দেখছে একবারও?
আরও পড়ুন
শুধু বিধবাদেরই নয়, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে অনেককেই মাসিক ভাতা দিতেন বিদ্যাসাগর
Powered by Froala Editor