ঠিক যেন পুরনো ভাঙা রাজবাড়িতে রহস্যানুসন্ধান। গুদামঘরের কোণায় পড়ে আছে একটা সিন্দুক। ধুলো পড়া, কালো। জং ধরেছে। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায়নি এতদিন ওই দিকে। তবে কৌতূহল যে হয়নি, তা নয়। আশেপাশের আলমারি, দেরাজগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে, সেসবের মাঝখানে একতাড়া রহস্য নিয়ে পড়ে আছে সিন্দুকটি। অবশেষে ছেনি, হাতুড়ি নিয়ে ঢোকা হল গুদামঘরে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর, খোলা হয় সেই সিন্দুক। আর সেখান থেকেই উদ্ধার হল ‘গুপ্তধন’! না, কোনও রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির প্লট নয়। খোদ কলকাতায় ভরদুপুরে ঘটেছে এমনই আশ্চর্য ঘটনা। স্থান সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্প্রতি সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত সেই সিন্দুকে বিভিন্ন পদক, নথির পাশাপাশি পাওয়া গেছে ১৯৫৪ সালের একটি নথিও। ১৮৫৪ সালে, বিধবা ভাতা দেওয়া চালু করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তখনও বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়নি। মুক্তাকেশী দেবীর বিধবা ফান্ড নামাঙ্কিত সেই তহবিল থেকে প্রতি মাসে ২ টাকা করে ভাতা দেওয়া হত বিধবাদের। সেখানে ৮ জন বিধবার অর্থপ্রাপ্তি স্বীকারের খাতাও আছে। দু’জন সই করে ও বাকি ছ’জন টিপসই দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন সেই ভাতা।
তবে, বিধবা ভাতার প্রসঙ্গ নতুন হলেও, বিদ্যাসাগর শেষ বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষকেই ভাতা দিতেন। মাসোহারাও বলা চলে। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে দেওয়া হত এই ভাতা। বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন বিদ্যাসাগরের এই উদ্যোগগুলির সম্পর্কে।
যতবারই নিজের গ্রাম বীরসিংহে যেতেন বিদ্যাসাগর, গঙ্গাধর দত্তের দোকান থেকে ৫০০ টাকার শাড়ি কিনে অনাথা মহিলাদের দিতেন। বন্ধু ও সহপাঠী মদনমোহন তর্কালঙ্কার মারা যাওয়ার পর, তাঁর মা বিশ্বেশ্বরী দেবীর জন্য মাসিক ১০ টাকা ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই ভাতা নিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবী কাশীতে বসবাস শুরু করেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত, টানা ১৮ বছর বিদ্যাসাগরের থেকে নিয়মিত এই ভাতা পেয়েছিলেন তিনি।
এছাড়াও ভরতচন্দ্র শিরোমণির গুরুকন্যা বৃদ্ধা বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর জন্য আমৃত্যু মাসিক ৪ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। দীর্ঘগ্রামের আরেক অসহায় মহিলাও মাসিক ৩ টাকা করে পেয়েছিলেন টানা ১২ বছর, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
শুধু মহিলারাই নন, বিভিন্ন বিশিষ্ট বৃদ্ধ ভদ্রলোককেও প্রতিমাসে টাকা দিতেন বিদ্যাসাগর। তারাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ৪ টাকা, বাপুদেব শাস্ত্রী ২ টাকা, রাধানাথ চক্রবর্তী ৩ টাকা করে পেতেন বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে। এছাড়াও রামমাণিক্য তর্কালঙ্কারের জন্য ১০ টাকা, চিন্তামণি ভট্টের জন্য ৩ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
শুধু তাই নয়, কতজনকে যে এককালীন টাকা দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি বাড়িতে অসহায় বৃদ্ধা ও মহিলারা এসে কষ্টের কথা জানালেই, তাঁদের ২ টাকা ও একটি কাপড় দান করতেন বিদ্যাসাগর। এমন উদাহরণ রয়েছে অজস্র।
বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ তম বর্ষে সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুঁজে পাওয়া নথি সেই পুরনো তথ্যগুলিকেই উস্কে দিল আরেকটু।