“১৭ বছর বয়সে আমার বিবাহ হয়েছিল। ১৯৭২ সালে। তারপর থেকে এই বাড়িতেই আছি। আজ এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথাও ভাবতে পারি না। আবার এখানে থাকাও একরকম অসম্ভব হয়ে উঠছে।” কথাগুলো বলছিলেন মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যি তারাদাস বন্দ্যোপাধায়ের স্ত্রী তথা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ৫ দশক ধরে ব্যারাকপুরে দুই সাহিত্যিকের স্মৃতিধন্য ‘আরণ্যক বাড়িতেই আছেন তিনি। কিন্তু এখন বাড়ির গা ঘেঁষে নির্মীয়মান শপিং কমপ্লেক্সের চাপে সেই থাকা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।
“বিভূতিভূষণ এই বাড়িতে কোনোদিন থাকেননি। ১৯৫০ সালে দাদুর মৃত্যু হয়। এর বছর পাঁচেকের মধ্যে ঠাকুমা রমা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন।” জানালেন তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়ি তৈরির পর থেকেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাধিক স্মৃতি দিয়ে সাজিয়েছেন রমা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজও ‘আরণ্যক’-এ পা রাখলেই সেইসব স্মৃতির সোঁদা গন্ধ নাকে এসে ভিড় করে।
বছর দুয়েক আগেই এই বাড়ির গা ঘেঁষে শুরু হয় ‘শপিং কমপ্লেক্স’ তৈরির কাজ। নির্মাণ প্রকল্পের কোপে ভাঙা পড়ে বাড়ির পাঁচিলের একটি অংশ। পৌরসভার তরফ থেকে জানানো হয় এর জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া হবে। বলা বাহুল্য, সেই প্রক্রিয়া কিছুই এগোয়নি। তাছাড়া, যে স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়, তার কি কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব? উল্টোদিকে পৌরসভার তরফ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছে, মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ছেলেই উন্নয়নের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন।
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, “শপিং কমপ্লেক্স তৈরির জন্য বাড়ির পিছনের জল নিকাশি ব্যবস্থা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর এর মধ্যেই গত আমফান ঝড়ে এক হাঁটু জল জমে যায় বাড়িতে। একতলায় বিভূতিভূষণের ব্যবহৃত সমস্ত জিনিস দিয়ে যে মিউজিয়াম আছে, তার অনেক জিনিসই নষ্ট হয়ে যায় সেই জমা জলে।” এই নষ্ট হওয়া জিনিসের মধ্যে আছে বিভূতভূষণের নানা পোশাক থেকে শুরু করে অপু ট্রিলজির পাণ্ডুলিপিও।
আরও পড়ুন
ঠাকুমার কান্নায় পেয়েছেন বিভূতিভূষণকে, পারিবারিক স্মৃতিই প্রেরণা নাতি তৃণাঙ্কুরের
“দাদুকে তো আমরা কেউই পাইনি, তিনি যখন মারা যান বাবাও খুবই ছোটো। আমরা তাঁকে পেয়েছি শুধু এই বাড়িতে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য চিহ্ন আর ঠাকুমার স্মৃতিতে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানও এই বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।” এই সবই কি এবার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসে পর্যবসিত হবে? মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “বিভূতিভূষণ কে তাঁদের কাছে? কেউ না। অন্তত আমার এই বৃদ্ধাবস্থায় শরীরের কথা ভেবেও কিছুটা সহানুভূতিশীল হতে পারতেন। কনস্ট্রাকশনের কাজে যেরকম শব্দ হয়, সেটা এই বয়সে সহ্য করা প্রায় অসম্ভব।” এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের কর্তাদের কাছে বারবার ঘুরেও অবশেষে ব্যর্থ হয়ে এখন সাধারণ মানুষের শুভবুদ্ধির উপরেই ভরসা রাখতে চাইছেন তাঁরা। প্রিয় কথাসাহিত্যিকের স্মৃতিকে কি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে বাঙালি?
আরও পড়ুন
যে অভয়ারণ্যে পাখির কলকাকলি, ত্রস্ত হরিণের সঙ্গে রয়েছেন বিভূতিভূষণও
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মুছে আসা শালবন, মুছে আসা বাংলা, ফুলডুংরি পাহাড়— এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ