ভূত তাড়াতে ‘অগ্নিবাণ’, ‘শরীর বন্ধন’ কিংবা ‘রক্ষাবাণ’ – বিচিত্র সব মন্ত্রের গল্প

গা ছমছমে এক গ্রামের কথা। সেই গ্রাম থেকে প্রতি পূর্ণিমার রাতে চুরি যেত কিছু না কিছু। জানা নেই কোন সম্মোহনে গোটা গ্রামবাসী বেহুঁশ ঘুমিয়ে পড়ত সে দিন। চোর কে? চোরের দেখা নেই! তবুও সিঁধকাঠি যে গড়তেই হবে। ঠিক হল গেরস্থের মনিব রাত জাগবেন আগামী পূর্ণিমায়। ক্ষণ এল। আর ক্ষণের সঙ্গে ঘুমও এল! ফুড়ুৎ হল ঘরের মাল! পর দিন গ্রামবাসী ছুটল রাশভারী এক গুণিনের কাছে। সব শুনে চোখ বুজলেন তিনি। তার পর ‘হ্রিং ফট’। আগুনে ঘি। পাওয়া গেল গ্রামের চোরের তল্লাশ! অনেকদিন আগে চোর মরেছিল এই গ্রামে। চোরের বউ কাঁদতে কাঁদতে চোরাচুন্নি হল। এই চোরাচুন্নি ভূতই প্রতি পূর্ণিমায় অনিষ্ট করছে অন্দরমহলের। তা হলে উপায়? গুণিন দিলেন গঙ্গজল। তার সঙ্গে হাতে নিলেন একটা নতুন মাটির কলসি। তার ভিতর জল আর তিল ভরলেন। তার পর তার স্বর তারস্বর! গড়গড়িয়ে মন্ত্র কাটলেন তিনি...

এই টোটকার নাম তিলপোড়া বা জলপোড়া। একে বলে, জলের ছিটে দিয়ে লগির গুঁতো খাওয়ানো। জলের শত্রু যেমন পানা, তেমনই মানুষের শত্রু কানা। মন কানা হলে তোমার শক্তি কমবে। তুমি অন্ধ মানেই তোমার বিশ্বাসের পরিধি সংকীর্ণ। ভয় তো মানুষের মনে। আর ভয়-মুক্তির জন্য অন্ধবিশ্বাস তিলে তিলে দমন করে আত্মবিশ্বাস। কোনো এক ক্যারিশমায় জাগন্ত ঘরে চুরি হল না এর পরে। স্বাভাবিক ভাবেই ওই গুণিন তখন ভগবান। একটু বর্তে দিও বাবা। মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না, ওকে কি ডাইনিতে পেয়েছে? রাগী গুণিনের হাতে ঝাঁটা। মুখে খেউর। চোখে ঘোর। সন্দেহের ঠোঁট শব্দ কাটে। মাগী যাবি আমগাছে, নাকি ঝেঁটাব? তার পর চোখে মণি ঘুরল তার। বিড়বিড় করে কী বেশ একটা জপে চিৎকার জুড়ল হঠাৎ— সরে যা, যেখানে আছিস নড়ে যা। জয় ভূতনাথের জয়... জয় শিব শংকর...। ব্রুম ব্রুম শব্দে গুণিনের ঘাড় গোল গোল ঘোরে। আবারও শুরু হয় তার চিৎকার...

এমন করেই ভূতভাগিয়ে গুণিনরা ভূত তাড়ায়। আর এতেও যদি মনে হয় ভূতবাবাজি যাননি, তা হলে ‘অগ্নিবাণ মন্ত্র’ হল শেষ অস্ত্র। চালের খড় দিয়ে তৈরি করা হয় মশাল। শুরু হয় মন্ত্রপাঠ। এক লেখায় পড়েছিলাম এই মন্ত্রের কথা। সেই সময় টুকে রেখেছিলাম। এমন ছিল মন্ত্রটি―

অষ্টবজ্র করলাম এক, অষ্ট দেবতার বরে।
অষ্টবজ্রের তেল নিলাম শক্তির শক্তি ধরে।।
অগ্নিবান সৃষ্টি হল ব্রহ্মার দোহায়ে।
হান হান শব্দে বান চলল আকাশ ছেয়ে।।
ওঁ হরি নারায়ণ বাজের মুখে জ্বলে।
নাগ-মানব-দেব-দানব কাঁপল ব্যাকুল হয়ে।।
স্বর্গ কাঁপে, মর্ত্য কাঁপে, পাতাল কাঁপে ভয়ে।
যা চলে যান (অমুক/অমুকির নাম ধরে)।।
যে দেহ আশ্রয় করে।
পুড়িয়ে ফেল, কটি অঙ্গ তার।।
তেত্রিশ কোটি দেবতার হকুম।
লাগ লাগ শিগ্গির লাগ।।

আরও পড়ুন
‘নিজে ভূত হয়ে ভয় পাচ্ছ! লজ্জা করে না?’

ওষুধ ধরেছে এবার! ধরবে নাই বা কেন? মশালের আগুনে ফুঁ দেন গুণিন। ভূতে পাওয়া মানুষটির সর্বাঙ্গে ধোঁয়া লাগে। সঙ্গে চলে ঝাঁটার পর ঝাঁটার ঝাঁপটা কিংবা চুলের মুঠি ধরে আঘাত। এহেন ঝাড়ফুঁকে ভূত তো মরবেই, স্বয়ং ভূতের বাপেরও শ্রাদ্ধ হয়ে যাবে। তার জন্য ইশারাই কাফি। গুণিন চোখ বন্ধ করলেই যেন প্রলয় বন্ধ হবে। এমন করেই ঠান্ডাও হবে অশরীরীর উৎপাত। এ সব আটপেরে ভূতের গল্প আকচার শোনা যায়। ভূতেদের আমড়াগাছি করলেই নাকি বশ মানে তেনারা। তাজ্জব ব্যাপার! ভূতেদের আবার তোষামোদ! আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ছোটোবেলার চোর-চোর খেলার কথা। নামপাতানোর সন্ধিক্ষণে আমরাই তো গুনতাম কর। ভূত আমার পুত পেত্নি আমার ঝি/রাম লক্ষ্মণ সাথে আছে করবি আমায় কি? গুণিনের টোটকায় এ হল ‘শরীর বন্ধন মন্ত্র’। ডাক-ডাকিনি-ভূত-প্রেত তোমরা পঞ্চু ভাই/আমার শরীরে আসে কারো সাধ নাই। ভূতখুনি গুণিন সাধুবাবা দিলেন মাদুলি। শর্ত প্রতি পাক্ষিকের অমাবস্যায় শোধন করতে হবে। হক কথা। নইলে আহাম্মক রুষ্ট হবেন যে! মণিমুক্ত দোলে মা মনসার গলে।/আমাকে দেখিয়া ভূত পিশাচ না চলে।।/কাঙ্গুরি কামিখ্যা মাণ্ডির আজ্ঞা হারিমির পো।/দোহাই মা কষকালী, দোহাই মা ফুল্লরা, দোহাই মা কালী।। 

আরও পড়ুন
ভূতচতুর্দশীতে আজও তৈরি হয় পেত্নীর মূর্তি; ঐতিহ্যের আড়ালে প্রেতচর্চার ইতিহাস?


আরও পড়ুন
‘রিকশা টানাচ্ছেন ভূতকে দিয়ে! আপনি নিজে পারবেন?’

তবে সাধুবাবার রক্ষাকবচ কী? পরম্পরায় আছে ভূতজব্দ করার দিনে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তিনি প্রথমে ডান পা বাড়ান (নারী হলে বাঁ পা)। তার পর সূর্যদেবকে স্মরণ করে দশবার জপ করেন গুরুর দেওয়া ‘আত্মসার মন্ত্র’— আত্মসার মহামন্ত্র গুরু দিল মোরে।/তাহারে সন্তোষ করিলাম নমস্কারে।। বিশ্বাস এই ‘হ্রিং’ মন্ত্র দশবার জপলেই কার্যসিদ্ধি। ‘হ্রিং’ এই মহামন্ত্র পাহাড় চলে যায়।/‘হ্রিং’ মন্ত্রে দেহের আমার সব দায় কেটে যায়।। 

এমন দিনেও ভূতেরা ফাঁকি দেয় বিজ্ঞানকে। বিধি যদি হয় বিপরীত, কেবা করে তার হিত! মনে প্রশ্ন জাগে, যা কিছু দ্রষ্ট, তা কি সত্য? আসলে চোখ যেখানে পৌঁছায় না, সেখানেই ‘অন্যকিছু’ ঘটে। মন্ত্রে যদি জোর থাকে তা হলে ঝাঁটার বাড়ি আঘাত করতে হয় না। ভূতরোগ এমনিই সারে। আবার ভূতরোগ বাড়ে কুসংস্কারী সঙ্গদোষে। কালের খাতায় ভূতের বাসা। প্রাচীনকালের মন্ত্র এখন অপভ্রংশে বাংলা ভাষায় রচিত। যার সাহিত্যগুণ অকুলান। বাস্তবে তেনাদের উপস্থিতি টের পেতে গেলে নাকি পরিবেশ লাগে। সেই পরিবেশে ভূত পিণ্ডি পায় না, কেত্তন চায়। সেই সব ভূতেদের কেত্তন দেখতে ডাকতে হয় না গুণিনকে। আমাদের পোড়াদেশে ভূতভাগাতে মাঝেমাঝেই তাই এক হন কৃষকরা। বছর পাঁচ আগে নন্দদুলাল আচার্য নামে আসানসোলের এক কবির লেখায় পড়েছিলাম এমনই কোনো প্রতিবাদ। ‘আর উলুক রূপে চক্রবাক রূপে সহমূল/মূরদেব নষ্ট করেন বোনের পেটের ফুল/...চালিয়ে দিলাম কামলা রোগ টিয়া পাখির গায়ে/সাহস রাখুন ভগ্নি-কন্যা ডাইনি-লাগা গাঁয়ে/পৃষ্ঠে আছেন মহেশ্বর বাতাস উল্টো কুলোর/তিন মাথা দানোর ছয়টা চোখে ছড়াই ধুলো/আর ফুস মন্তর ছুঃ, এই মন্ত্র নড়ে/জন-গণেশ আছে হে বাপ মাথার উপরে।’ হুই মেঠোভূত মূরদেবকে আমরা মারব! কার আজ্ঞা?— মৃত্তিকার।

(ছবি - প্রতীকী)

Powered by Froala Editor