সময়টা সত্তর দশকের মাঝামাঝি। টিভির জন্য একটি বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান করা হবে। সাজো সাজো রব সেটে। ঠিক যেরকমভাবে এতদিন অনুষ্ঠান হয়ে এসেছে, তেমনটা হবে না। গান যেন জীবনযাপন, আমাদের চলার পথের অঙ্গ হয়ে ওঠে— এমন ভঙ্গিতেই পুরোটা উঠে আসবে টিভিতে। ওই তো দেখা যাচ্ছে নদী বয়ে যাচ্ছে, কূল কিনারা কিছুই নেই। অথৈ জলের ভেতর বেজে উঠছে দুই ধারা— গঙ্গা ও পদ্মা। হঠাৎই দৃশ্যের ভেতর থেকে বেজে উঠল স্বর। কেউ গেয়ে উঠলেন চিরপরিচিত দরাজ গলায়, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’। মাথায় টুপি, হালকা করে ছাঁটা গোঁফ। ভূপেন হাজারিকা চলে যাচ্ছেন অন্য গানে। জীবন তরণীটি দুলে উঠছে একটু একটু। চাবির গোছা বাজিয়ে সঙ্গ দিচ্ছেন রুমা গুহঠাকুরতা…
জীবনের একটা সময় এমনই যাযাবর ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। নিজের গানেই সে কথা বলে গেছেন। উত্তর-পূর্বের ভরা সবুজ, খরস্রোতা নদী আর পাহাড়ের আঁচলে ছুটে চলা ছেলেটার মধ্যে থেকে সেই পাখিটা কখনও যায়নি। চলে গেছেন সব জায়গায়, সমস্ত মানুষের কাছে। আইপিটিএ-র সঙ্গে যুক্ত হওয়াই হোক, বা গান গেয়ে পাহাড়ের দাঙ্গা থামানোর উদ্দেশ্যই হোক— সেই মানুষই ছিল ভূপেন হাজারিকার মন্ত্র। সেই মন্ত্রের বলেই শুনতে পেয়েছিলেন ‘বিস্তীর্ণ নদীপাড়ের অসংখ্য মানুষের হাহাকার’…
এমন এক যাযাবরের জীবনে লেগেছিল রঙের পরশ। খরস্রোতা নদী ধীরে ধীরে হাজির হল মসৃণ সমতলে। ভূপেন হাজারিকার জীবনে সেই পাখিটি ছিলেন কল্পনা লাজমি। ‘রুদালি’র পরিচালক ভূপেনের জীবনে এসেছিলেন সেই শান্ত পায়রাটি হয়ে। যাযাবর জীবনটাকে এক নিমেষে শান্ত করতে, স্থিতধী করতে। নিজের কিশোর বয়স থেকেই কিংবদন্তি সঙ্গীতসাধকের ভক্ত ছিলেন কল্পনা। তিনি তখন মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সাইকোলজির পড়ুয়া। নিজের পরিবারেও শিল্প-সংস্কৃতি-সিনেমার প্রভাব দেখেছিলেন কল্পনা লাজমি। মা ললিতা লাজমি ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, আর মামা ছিলেন কিংবদন্তি গুরু দত্ত। তাঁর নিজের ভেতরেও চলচ্চিত্র পরিচালনার সত্তা ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল। এমনই পটভূমিকায় আলাপ ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে। কল্পনা তখন সদ্য যৌবনে। বয়সে ২৮ বছরের বড়ো গায়কের সুরে মজে গেলেন তিনি। সেই যে মিলন হল, তা জারি ছিল ২০১১ সালে ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
সেই সময় ভূপেনবাবুও টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথম স্ত্রী প্রিয়ংবদা প্যাটেলের সঙ্গে বৈবাহিক জীবনে সমস্যা কোথাও মানতে পারছিলেন না। ওই দরাজ গলা বারবার বেছে নিত প্রেমকে। সেই প্রেমকেই হয়তো খুঁজছিলেন ভূপেন হাজারিকা। কিন্তু, এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। ক্রমশ মদের নেশা চেপে বসছিল তাঁকে। বেহিসেবে কেটে যাচ্ছে সময়। টাকা কোথায় যে খরচ হয়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে না। হয়তো হারিয়েই যেত নৌকাটি। শক্ত করে দড়িটুকু ধরলেন কল্পনা লাজমি। ‘আরোপ’-এর সেটে আলাপ দুজনের। তারপর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় দুজনেই কলকাতার বাড়িতে একসঙ্গে থাকতে আরম্ভ করলেন। ২৮ বছরের ব্যবধান! সেসব তুচ্ছ করে শক্ত বাঁধনে বাঁধলেন ভূপেন-কল্পনা। প্রথাগত বিবাহ হয়নি তাঁদের; সন্তানধারণের পথেও হাঁটেননি। বেঁচেছেন কেবল ভালোবাসার শর্তে। অলক্ষ্যে কেউ গাইছিল ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী’?
সত্যিই অনেক ‘কলঙ্কের’ তির ছুটে এসেছিল তাঁদের দিকে। কিন্তু এবারে যে নৌকাটি ভগ্ন, জীর্ণ নয়! ভূপেন হাজারিকার জীবনসঙ্গীই শুধু নয়, তাঁর ম্যানেজারের দায়িত্বও নিলেন কল্পনা লাজমি। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি প্রচণ্ড গুরুত্ব দিতেন নিয়মকে। সেই ছকবাঁধা, স্থির একটা যাপনই আনলেন ভূপেনের জীবনে। যাযাবরের ঘরে ফেরার গান। পরে নানা সময় ভূপেন হাজারিকাও বলেছিলেন কল্পনার এমন অবদানের কথা। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘এক পল’-এর জন্য সঙ্গীত পরিচালনাও করেছিলেন। কল্পনা লিজমির ‘রুদালি’র জন্য জাপানে এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা সঙ্গীতের পুরস্কারটিও পান ভূপেন হাজারিকা। তাঁর আগে আর কোনো ভারতীয় ওই মঞ্চে পুরস্কার পাননি। একইসঙ্গে এসেছিল সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, পদ্মভূষণ।
ভূপেন হাজারিকা ভারতের সেই বিরল সন্তানদের একজন, যিনি দেশের চারটে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পেয়েছিলেন। কল্পনা লিজমি জীবনে না এলে যাযাবর জীবনটা আরও বৃদ্ধি পেত। কী হত, বলা কঠিন। যা হয়েছে, তা-ই বা কম কী! সুরের ভেলায় কাটিয়ে দিয়েছেন দুজনে। বয়সের ব্যবধান মুছে এক হয়েছেন, তৈরি করেছেন সঙ্গীতের সংসার। সেখানে যত কটাক্ষই আসুক না কেন, ভিতটুকু যে মজবুত!
আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরীর গান গাইলে থাকা যাবে না শান্তিনিকেতনে, রেকর্ডিং করেও পিছিয়ে এলেন কণিকা
Powered by Froala Editor