তৃতীয় পর্ব
প্রত্নতত্ত্ববিদরা ভীমবেটকায় পাওয়া পাথরের অস্ত্র, প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কাল, ভস্মচূর্ণ এবং মৃত্পাত্রের টুকরো নিয়ে অনেক গবেষণা করে ১ লক্ষ বছরের ইতিহাস অনুমান করেছেন। কিন্তু আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের কাছে ভীমবেটকার মাহাত্ম্য হল তার গুহার দেওয়াল চিত্রণ। এখনও যা বর্তমান হয়ে দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিচ্ছে মানব ইতিহাস বদলের। কালের স্রোত যাকে বিনষ্ট করতে পারেনি। মুছে যায়নি সেইসব গুহাচিত্রের রং।
প্রথম পর্ব
ছবি আঁকলে সহজ হবে শিকার, ভাবত ভীমবেটকার শিল্পীরা
যে গুহাচিত্রগুলি এখনও বর্তমান সেগুলির কাল নির্ণয় করে দেখা গেছে যে, সম্ভবত ৯ হাজার বছর(মেসোলিথিক যুগ) থেকে ২৫০০ বছর আগে অবধি এগুলি আঁকা হয়েছিল। অতএব এই গুহাচিত্রগুলি ভারতবর্ষের মানব সভ্যতার ৬৫০০ বছরের দলিল। এই সাড়ে ৬ হাজার বছরের মানবজাতির যা চিন্তার পরিবর্তন হয়েছিল চিত্র অঙ্কনের প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছিল এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল তারও নজির রয়ে গেছে ভীমবেটকার এই দেওয়ালে।
দ্বিতীয় পর্ব
এই গুহাগুলির সামনেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহাভারতে ভীম
ছবির বিষয়বস্তু প্রথমে ছিল পশুপাখির। পরে তার সঙ্গে জুড়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুর অবয়ব। তারও পরে পশুর সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ, পশুর পিঠে মানুষের আরোহণ ইত্যাদি। আবারও দেখা গেল কিছু তদানীন্তন সামাজিক পটভূমি। ঘোড়ায় চড়া ও মাথায় ছাতা নেওয়া রাজার ছবির অপূর্ব চিত্র, যা এখনও নজর কাড়ে। এছাড়াও রয়েছে জ্যামিতিক নকশাচিত্র। এর থেকে বোঝা যায় যে, কালের আবর্তনে সমাজ কীভাবে পাল্টে গেছে।
কিছু কিছু ছবিতে শিকারের দৃশ্য ও নৃত্যরত মানব-মানবীর দেহ লক্ষ্য করা গেছে। মজার ব্যাপার হল, এই মানব-মানবীর আঁকার ধরণটির সঙ্গে এখনকার সাঁওতাল ও তফশিলি উপজাতির পুজোর সময় গৃহ অলঙ্করণের দেওয়াল চিত্রের বেশ ভালরকম মিল পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার এক অত্যাশ্চর্য নিদর্শন এই ভীমবেটকা। সাড়ে ছ'হাজার বছরের বিবর্তনে ছবির বিষয়বস্তু যেমন বদলে গেছে, ঠিক তেমনই পাল্টেছে ছবি আঁকার পদ্ধতি, ব্যবহৃত রং ও সরঞ্জাম।
১৮৮৮ সালে ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ভীমবেটকার কথা নথিভুক্ত করেছিল এক বৌদ্ধ edifice হিসাবে।
ভীমবেটকার গুহাচিত্রে তিন ধরণের ছবি দেখা যায়। যা এখনকার ছবি আঁকার টেকনিক্যাল ভাষায় জল রং, তেল রং এবং শুকনো মোম রং। বেশিরভাগ ছবি সাদা ও লাল রঙে আঁকা। কিন্তু কিছু কিছু সবুজ, কমলা, হলদে ও বেগুনি। এই সব রং, রং করার পদ্ধতি এবং ছবির বিষয়বস্তু দিয়ে ভারতের যে ইতিহাস ফুটে ওঠে তাতে একটি অসাধারণ ইঙ্গিত আছে। সম্ভাব্য ৫০০০ বছরের আগে কোনো ছবিতে ঘোড়া জাতীয় কোনো পশু দেখা যায় না। এ থেকে মনে হয় যে, ৫০০০ বছর আগে যখন আর্য সভ্যতা ভারতে প্রবেশ করে সেই সময় থেকেই দেশে ঘোড়া আমদানি হয়।
অজন্তার মত সারা বিশ্বে বিখ্যাত, ভারতের প্রাচীনতম শৈলাশ্রয় তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, এই ভীমবেটকা। তাই এর বিষয়ে বর্ণনা প্রথমেই করতে হয়। ঐতিহাসিক ওয়াকাঙ্কারের ১৯৫৭ সালে এই আবিষ্কারের অনেক বছর আগেই, ১৮৮৮ সালে ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ভীমবেটকার কথা নথিভুক্ত করেছিল এক বৌদ্ধ edifice হিসাবে। তার কারণ, স্থানীয় অধিবাসীরা এই জায়গা সম্পর্কে এমনই ধারণা করতেন।
ভারতবর্ষের লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার এক অত্যাশ্চর্য নিদর্শন এই ভীমবেটকা।
১৯৫৭-র কিছু আগে ড. ওয়াকাঙ্কার ভীমবেটকার পাশ দিয়েই দক্ষিণের সঙ্গে সংযোগকারী এক প্রধান রেলপথ হয়ে যাবার সময় এখানে কিছু টিলা দেখতে পান। সেগুলোর গঠনের সঙ্গে ফ্রান্স ও স্পেন-এর কিছু টিলার গঠনের সাদৃশ্য লক্ষ করেন। ফ্রান্স ও স্পেন-এর ওই টিলাগুলি বিখ্যাত শৈলাশ্রয়। ড. ওয়াকাঙ্কার এই সূত্র ধরেই কিছু দিন পরে ভীমবেটকায় আসেন আর পৃথিবী ‘ভীমবেটকা’ সম্পর্কে জানতে পারে।
(ক্রমশ)