আরাবল্লী পর্বতমালায় ঘেরা গুজরাত রাজ্যের খেড়ব্রহ্মা-দাঁতা এবং রাজস্থানের কোটরা তালুকে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কিছু ছোটো ছোটো গ্রামে বাস ভিল আদিবাসীদের বাস। তাদের মধ্যে পরম্পরাগতভাবে বহুকাল ধরে মুখে মুখে প্রচলিত এক নিজস্ব মহাভারত-গাথা। সেই কাহিনীর মৌখিক সম্পূর্ণ রূপটি সংগ্রহের জন্য ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ - দীর্ঘ চার বছর ধরে সেইসব পাহাড়ি অঞ্চলে নিজে উপস্থিত ছিলেন ভগবানদাস প্যাটেল। সারা বছর ধরে, ঋতুচক্র অনুযায়ী তাদের যে বিভিন্ন ধর্মীয়-সামাজিক অনুষ্ঠান হয়, সে সবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। গায়েনদের মুখ থেকে একটু একটু করে সংগৃহীত সম্পূর্ণ গাথাটিকে সম্পাদিত করে তিনি পুস্তক আকারে প্রকাশ করলেন। সে বইয়ের নাম হল ‘ভিলো নু ভারথ’।
এই ভিল মহাভারত প্রকাশ হওয়া মাত্র ভারতের গবেষক মহলে সাড়া পড়ে গেল। বিভিন্ন ভাষায় বইটির অনুবাদকর্ম শুরু হল। হিন্দিতে অনুবাদ করলেন মৃদুলা পারিখ, ইংরেজী অনুবাদটি প্রকাশিত হল ড. গণেশ দেবীর সম্পাদনায়। আর বাংলা ভাষায় বইটির অনুবাদ করলেন জয়া মিত্র। ‘ভিল মহাভারত’ নামে সাহিত্য অকাদেমি থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশ পেল সেই অসামান্য বইটি।
সাধারণভাবে বাঙালিরা যে মহাভারতের সঙ্গে নিত্য পরিচিত তা হল, পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে লেখা কাশীদাসী মহাভারত, রাজশেখর বসু-কৃত মূল মহাভারতের সারসংক্ষেপ, আর কালীপ্রসন্ন সিংহ সম্পাদিত বৈয়াসকী মহাভারতের সম্পূর্ণ গদ্যানুবাদ। এছাড়া বিশেষ আগ্রহী ধীমান ব্যক্তিরা হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ সম্পাদিত সটীক মহাভারতও পাঠ করে থাকেন। কিন্তু, এই ভিল মহাভারত পাঠ করার পর সেই সমগ্র ভুবন বিপুলভাবে নাড়া খেতে বাধ্য। আমাদেরই দেশের এক প্রাচীন জনগোষ্ঠী কত ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রাগৈতিহাসিক রণগাথাকে দেখেন, কীভাবে তারা সেটির আত্তীকরণ করেছেন - সেই আশ্চর্য আত্মীকরণের ইতিবৃত্ত জানতে হলে এ বই অপরিহার্য।
এই ভিন্নতা কেবল কাহিনির বহিরঙ্গ প্লটের পার্থক্যে নয়, অন্তর্গত বার্তায়। বেশিরভাগ আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো ডুঙ্গরিয়া ভিলদের মধ্যেও জমির ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাটি অনুপস্থিত। কৃষিকাজ এঁদের প্রধান জীবিকা নয়। ফলে আমাদের পরিচিত মহাভারতের মূল উপাখ্যানটি যেভাবে ভারতের একটি প্রধান রাজবংশের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, জমির মালিকানার অধিকার ও তার বিস্তারকে মূল অবলম্বন ধরে রচিত, এই ‘ভিলো নু ভারথ’ একেবারেই তা নয়। সুতরাং, সোনার টাকা ভরা চিঠি পাঠিয়ে রাজ্যপাট ঠিকমতো ভাগ করে দেবার জন্য পাণ্ডব ও কৌরব উভয়পক্ষই কৃষ্ণকে আহ্বান জানায় বটে, কিন্তু তাতে পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় কেবল। মূল সমস্যার কোনও সুরাহা হয় না। অতএব, যুদ্ধ। বৈয়াসকী মহাভারতে যেখানে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য ও সৌপ্তিক- এই পাঁচখানা পর্ব জুড়ে বিপুল বিস্তারে যুদ্ধের বর্ণনা চলে, ভিল মহাভারতে সেই বিশাল যুদ্ধের বিবরণ মাত্র এক অধ্যায়ে অতি সংক্ষেপে শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধের শুরুতে কুন্তী কর্ণকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করে নিয়ে আসেন তার অগন-পিছৌড়া বা আগুন-চাদর, কৌশলে অভিমন্যুর জন্য আদায় করে নেন তার ধনুর্বাণ। রবি ঠাকুরের ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’ পড়ে অভ্যস্ত বাঙালি পাঠকের কাছে কুন্তীর এই অনায়াস, নির্লজ্জ ও নির্দয় স্বার্থকৌশল রীতিমতো ভয়ঙ্কর মনে হবে। আর যুদ্ধের ঘটনাও সেখানে আঠারো দিনের নয়, সাত দিনের - প্রতিদিন বালা হিম্মত ওরফে অভিমন্যু কৌরবপক্ষের এক একটি কোঠা (ব্যূহ) ভঙ্গ করেছে। জলঘর, সোনার ঘর, কাঁসার কোঠা, পিতলের কোঠা ইত্যাদি নষ্ট করার পর একেবারে সপ্তম দিনে, শেষ ব্যূহটি ভাঙার আগেই কৃষ্ণের কৌশলে অভিমন্যুর মৃত্যু ঘটল। জানা গেল, এই অভিমন্যু প্রকৃতপক্ষে ইকো দানব, যে কীটের রূপ ধরে সুভদ্রার উদরে আশ্রয় নিয়ে তার সন্তানরূপে জন্মেছিল। তাই, আটাত্তর (হ্যাঁ, ভিল ভারতে তাদের সংখ্যা এক শত নয়, আটাত্তর) কৌরব ভাইয়ের নিধন মাত্র নয়, কূটকৌশলী ইকো দানবের নিধনই এই যুদ্ধে কৃষ্ণের অন্তিম সাফল্য।
যুদ্ধের প্রসঙ্গে একটি কথা বলতেই হয়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সপ্তম সূক্তে মৃত ব্যক্তির পরিজনদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তির জন্য শোক করছ সে জীবিতকালে তোমাদের আত্মীয় ছিল। কিন্তু এখন সে মৃত। মৃতদের সঙ্গে জীবিতদের কোনও সম্পর্ক থাকে না। তোমরা শোক ভুলে বাড়ি যাও।” ভিল মহাভারতের ‘অরঝন নো হোগ’ (অর্জুনের শোক) অধ্যায়ে দেখি শোকাহত অর্জুনকে সান্ত্বনা দিয়ে মূর্তিমান শ্মশান বলেছে, “বালার কথা মনে করে কেন শোক করছ? যতদিন সে জীবিত ছিল, ততদিন তোমার ছিল। এখন আর সে তোমার কেউ নয়।” এইখানে এসে আমাদের স্তম্ভিত হতে হয়। আমরা আবিষ্কার করি, ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণের যে চিরন্তন বাণী “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং” তা ভারতের সুসংস্কৃত নাগরিক সমাজে যেমন, তেমনই পার্বত্য আদিবাসী গোষ্ঠীর চেতনার মধ্যেও অনাদিকাল ধরে বয়ে চলেছে অন্তর্লীনভাবে।
এই গাথার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে প্রথাগত পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধ সুর। স্ত্রীলোকের একগামিতা এখানে আবশ্যক নয়, তাই পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে ধোফা ওরফে দ্রৌপদীর বিবাহ অতি অনায়াসে ঘটে, সেজন্য পূর্বজন্ম-বৃত্তান্ত ইত্যাদি কাহিনীজাল সাজাতে হয় না। ‘ধোফাঁ ন বাসঙ্গ’ অধ্যায়ে দ্রৌপদীর রূপমুগ্ধ পাতালরাজ বাসুকি নাগ অর্জুনের প্রাসাদে এসে অর্জুনকে বন্দি করে সেই ঘরেই দ্রৌপদীর সঙ্গে নিশিযাপন করে। কয়েক রাত্রি এই উপদ্রব চলার পর দ্রৌপদী কর্ণের সাহায্য নিতে যায়, কর্ণ সূর্যদেবের কাছ থেকে আগুন-কাটারি নিয়ে এসে বাসুকিকে পর্যুদস্ত করে। কর্ণ-কৃষ্ণা-অর্জুন ত্রিকোণ নিয়ে কল্পনাবিহ্বল হালের কথাসাহিত্যিকদের চেয়েও কয়েক কদম এগিয়ে আছে ভিল ভারতের এই কাহিনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি এই যে, এত কাণ্ড ঘটার পরেও দ্রৌপদীর সতীত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এ ভিল জাতির চেতনায় অন্তর্নিহিত নারীপ্রাধান্যেরই ফল। সমগ্র কাহিনিতেই আমরা দেখি, কুন্তী ও দ্রৌপদীই সমস্ত বিষয়ে পঞ্চপাণ্ডবের নিয়ন্ত্রী ও চালিকাশক্তি।
আরও পড়ুন
একসময়ের শিকারিদের তত্ত্বাবধানেই গড়ে উঠেছিল দেশের প্রথম ‘গ্রিন ভিলেজ’
যে গাথায় বিলাসিতার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসাবে বারবার কেবল তামার কুণ্ডীতে জল গরম করে হাত-পা ঘষে ঘষে স্নান করানো, আর বত্রিশ ব্যঞ্জন রান্না করে বিছানায় বসিয়ে খাওয়ানো – এইই ফিরে ফিরে আসে, সেই গাথার মধ্যেও সন্ধানী পাঠক ঠিকই খুঁজে নেন একটি জাতির যৌথ মনস্তত্ত্বের উপাদান। ‘ভিল মহাভারত’ আমাদের বারেবারে বলে দেয়, বিবিধ বৈচিত্র্য সত্ত্বেও ভারতের অন্তরাত্মার মধ্যে আবহমান রয়েছে একটি অনাদি ঐকতান।
(ভিল মহাভারত।। সংকলক: ভগবানদাস প্যাটেল। বাংলা রূপান্তর: জয়া মিত্র। সাহিত্য অকাদেমি।)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দুষ্প্রাপ্য মহাভারত হোক বা কমিকস – কলকাতায় পুরনো বইয়ের ‘দেবদূত’ এই দীপঙ্করবাবুরাই