বাবা ছিলেন মন্দিরের সামান্য এক পুরোহিত। দিন গেলে যা উপার্জন, তাতে সংসারের পেট চালানোই দায়। সেইসঙ্গে সন্তানের পড়াশোনা চালানোর মোটা অঙ্কের খরচ। এসবের মধ্যে খেলাধুলোর পিছনে খরচ বাতুলতাই বটে। কিন্তু মেয়ের স্বপ্ন একদিন সে লড়াই করবে জাতীয় স্তরে। সেই স্বপ্ন তো আর মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। ফলত, খেলার সরঞ্জাম কিনতে সোনার গয়না বন্ধক রেখেছিলেন তাঁর মা।
না, নিরাশ করেননি সেদিনের সেই ছোট্ট খুদে। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রের সবথেকে বড়ো মঞ্চ অলিম্পিকে আজ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। লিখে ফেলেছেন এক নতুন ইতিহাস। কারণ এ খেলায় যে ভারতের কোনো প্রতিযোগীই অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি কোনোদিন। ভবানী দেবী। ভারতের প্রথম ফেন্সার হিসাবে অলিম্পিকের মঞ্চে এবার লড়তে চলেছেন তিনি।
অলিম্পিকে এশিয়া-ওসিয়ানিয়া বিভাগে ফেন্সিং-এর ব্যক্তিগত ইভেন্টের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র দুটি স্থান। তার মধ্যেই একটি স্থান দখল করে নেন তামিলনাড়ুর বছর সাতাশের মহিলা ফেন্সার। গত মার্চে হাঙ্গেরিতে আয়োজিত ফেন্সিং বিশ্বকাপে দলগত বিভাগে কোয়ার্টার ফাইনালেই হেরে যায় ভারত। ফলে ভালো পারফর্মেন্স মেলে ধরলেও সহায় হয়নি ভাগ্য। পরে সেমি ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে হাঙ্গেরি হেরে যাওয়ার পর বদলে যায় পয়েন্টের হিসেব-নিকেশ। ব্যক্তিগত র্যা ঙ্কিং-এ বেশ খানিকটা এগিয়ে ৪৫তম স্থান পান ভবানী। হাতে চলে আসে অলিম্পিকের টিকিট।
তবে এমন একটি খেলায় তাঁর ঢুকে পড়া প্রায় আকস্মিকভাবেই। ২০০৪ সালের কথা। বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। প্রথাগত পড়াশোনার বাইরেও ‘এক্সট্রাক্যারিকুলার’ হিসাবে বেছে নিতে হবে কোনো খেলাকে। এমনটাই নিয়ম ছিল স্কুলের। মোট ছ’টি বিকল্প ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল-সহ প্রচলিত খেলাগুলিতে নাম লিখিয়েও লাভ হয়নি। বিভাগগুলিতে আগেই পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ছাত্রসংখ্যা। ফলত, বাধ্য হয়েই ফেন্সিংকে বেছে নেন ভবানী। তখনও পর্যন্ত এ খেলার ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও জানেন না তিনি। যখন পরিচিত হলেন গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে, তখন আকাশ ভেঙে পড়ল পরিবারের মাথায়। এত খরচ এই খেলায়! তৎকালীন বাজারে শুধু কিটের দামই ছ’ হাজার টাকা। পাশাপাশি অন্যান্য সরঞ্জাম তো রয়েছেই। প্রাথমিকভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিভাগ পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন তাঁর বাবা-মা। কিন্তু একরত্তি মেয়ের জেদ চেপে বসেছে ফেন্সিং সে খেলবেই। ফলে বাধ্য হয়ে শুরু হয় অর্থের জোগাড়যন্ত্র করা। সোনা বন্দক দিয়েই শুরু হয় মেয়ের ফেন্সিং-এর প্রশিক্ষণ।
আরও পড়ুন
১৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়েও অলিম্পিকের মনোনয়ন পর্বে আমেরিকার অ্যাথলিট
তবে সেই সোনা যে ফিরত আসবে কোনোদিন তা স্বপ্নেও ভাবেননি ভবানীর বাবা-মা। এক দশকের মধ্যে পাল্টে যায় গোটা ছবিটাই। ২০১৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক মেডেল নিয়ে আসেন ভবানী। ইতালির তুস্কানি কাপে সোনা। তার বছর চারেকের মধ্যে প্রথম ভারতীয় হিসাবে ক্যানবেরা কমনওয়েলথ গেমসে আবার সোনার সাফল্য। বিশ্বকাপের একক বিভাগেও পদক আনেন ভবানী। জাতীয় স্তরে তো বটেই, বর্তমানে ৬টি আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
আরও পড়ুন
মেদিনীপুরের প্রণতিকে ঘিরে অলিম্পিকে পদকজয়ের স্বপ্ন ভারতের
২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকের একেবারে দোরগোড়া থেকেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। সামান্য পয়েন্টের তারতম্য বন্ধ করে দিয়েছিল যোগ্য অর্জনের পথ। তবে হারায়নি লড়াকু মেজাজ। তারপর প্রায় অজ্ঞাতবাসে চলে গিয়েছিলেন ভবানী। ইতালির প্রশিক্ষক নিকোলা জানোত্তির কাছে নতুন করে শুরু করেছিলেন প্রশিক্ষণ। পরিবার, দেশ ছেড়ে শুধু খেলার কাছেই সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। এই নিষ্ঠা বিফলে যেতে পারে নাকি?
আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় সাঁতারু হিসাবে সরাসরি অলিম্পিকে সজন প্রকাশ
কথায় রয়েছে, খেলা জনপ্রিয়তা পায় খেলোয়াড়ের দৌলতে। সেই কথাটাই যেন আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছেন ভবানী। ভারতে ক্রিকেট, ফুটবল নিয়ে পরিকাঠামো থাকলেও, আজও ব্রাত্য রয়ে গেছে ফেন্সিং। এমনকি অনেকের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই খেলা। তবে ভবানীর হাত ধরেই বদলে যাচ্ছে সামগ্রিক ছবিটা। ‘নতুন’ এই খেলাতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বুনছে ভারত। টোকিওতে জয় আসুক কিংবা না আসুক—তামিল তরুণীর এই লড়াই নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক…
Powered by Froala Editor