“ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি, পরিবারে মেয়েদের প্রতি একটু অন্যরকম ব্যবহার করা হত। আমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। যেন বাইরে থেকে এসেছি, পরিবারের অংশ নই আমি। সেখান থেকেই অনেক রকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। আমি তো একা নই, আমার মতো আরও অনেক মেয়েই ছড়িয়ে আছে চারপাশে। এই লিঙ্গবৈষম্য সমাজ থেকে তো এখনও যায়নি। তার ওপর জাতি দাঙ্গা তো লেগেই আছে। এই মেয়েগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, তাঁরাও যাতে স্বাধীনভাবে নিজের বাঁচার পথ খুঁজে নিতে পারে তাই আমি তাঁদের হাতটুকু ধরতে চেয়েছি।”
প্রহরকে বলছিলেন ভাওটিনা মুশায়রে। অসমের কোকরাঝাড়ের এক লড়াকু মেয়ে। পাহাড়ের খরস্রোতা নদীর মতোই স্বচ্ছ, অথচ যার ভেতর উঁকি দিলে দেখা যাবে এতদিনের জমে থাকা সমাজের যন্ত্রণাদায়ক দিকগুলো। ভাওটিনারা যুগ যুগ ধরে যে যন্ত্রণা সহ্য করে এসেছেন। আজ অবশ্য সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা। বেরিয়ে এসেছেন ভাওটিনা। রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন কি? পড়লে নন্দিনীর মতো করে শেকল ভাঙার গান গেয়ে নিতে পারতেন পাহাড়ি ভাষায়…
প্রতিটা ঘরে ভাই আর বোন একসঙ্গে বড়ো হলে বেশিরভাগ সময় একটা তুল্যমূল্য বিচার চলে। ভাই সবসময় মাছের বড়ো পিসটা পায়। সব বেশি বেশিই যেন ছেলেদের। এখন অবশ্য ভাবনা চিন্তার বদল ঘটেছে অনেকটা। কিন্তু শিকড় এখনও সেই জায়গাতেই। ভাওটিনার কি কোনো ভাই রয়েছে? জানা নেই। কিন্তু ছোটো থেকে তাঁকেও কম অশান্তি সহ্য করতে হয়নি। চুপচাপ ঘরেই বসে থাকতে হত। কাউকে ভরসা করে বলতেও পারতেন না। কাকেই বা বলবেন? তখন থেকেই অনুভব করেছিলেন, তাঁর মতো মেয়েদের জন্য কারোর দরকার। বড়ো হয়ে যে ভাবনাটা আরও পোক্ত হল। ২০১৫ সালে জন্ম নিল অ্যাকশন ফর ইনক্লুশন অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট বা এআইইটি। কয়েকজন মেয়ে মিলেই তৈরি করেছিলেন এই সংস্থা, যার মধ্যে একজন ভাওটিনা মুশায়রে। আজও এই সংস্থার মূল দায়িত্বে মেয়েরাই।
আরও পড়ুন
বাঙালিদের মধ্যে প্রথম মহিলা মার্শাল আর্ট ট্রেনার, মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সুতপা পাত্র
আরও পড়ুন
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নার্স হোচিমিন, বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনের অন্যতম মুখও তিনিই
যেখানে যেখানে মেয়েরা অত্যাচারিত হন, তাঁদের সাহায্যের দরকার হয়, ভাওটিনা এবং তাঁর সংস্থা তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যান সেখানে। তাঁদের অধিকারের জন্য লড়াইও করেন তাঁরা। একটা ঘরে বাকিদের মতো একজন মেয়েরও মতামতের দাম আছে। সেটা তাঁর অধিকার। সেটা কেন দেওয়া হবে না? এমনটাই প্রশ্ন ভাওটিনার। সেইসঙ্গে চেষ্টা করেন যে সমস্ত মেয়েরা সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদেরকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা। এআইইটি’র পক্ষ থেকে তাঁদেরকে প্রশিক্ষিত করে ছোটো ছোটো কাজেও যুক্ত করা হয়। আজ সেই মেয়েরা কেউ সেলাই করছে, কেউ চাষের কাজ করছে, কেউ আচার বানানোর কাজ করছে। শুধু বানাচ্ছেই নয়, বিক্রিও করছে। সবথেকে বড়ো কথা, এইভাবে পায়ের তলায় জমি ফিরে পাচ্ছে মেয়েরা। একটা সময় যে ভরসা হারিয়ে ফেলছিল তারা, সেই ভরসা ফিরছে। ভাওটিনার তো সেটাই স্বপ্ন!
আরও পড়ুন
বিবাহ থেকে পারলৌকিক ক্রিয়া - ছক ভাঙছেন কলকাতার 'মহিলা পুরোহিত' নন্দিনী
আরও পড়ুন
জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই, 'অস্ত্র' মেয়েদের ফুটবল ক্লাবও - দিনবদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রতিমা
তবে এই সবের পাশে আরও বড়ো কাজ ঘটে চলেছে সমান্তরালে। ‘অচলায়তন’-এর নিয়ম ভাঙার কাজ তো সবে শুরু। ভাওটিনা অসমের কোকরাঝাড়ের মেয়ে, সেখানেই তাঁর কাজকর্ম। যারা একটু খবরের কাগজ এবং ইন্টারনেট নাড়াচাড়া করেন, তাঁরা এই কোকরাঝাড় জায়গাটির নামের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। মনে করুন ২০১২ সাল। বোদো উপজাতি এবং আসামের বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে জাতি দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। দাঙ্গার ইতিহাস অবশ্য আরও প্রাচীন। তার বিস্তৃত ইতিহাস এখানে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু যুদ্ধ, দাঙ্গা এসব তো কোনদিনও কারোর ভালো করেনি! বরং সবাইকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। সদ্যোজাতকে অনাথ করে দিয়েছে, কয়েক হাজার পরিবারকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। ২০১২ সালের অসম দাঙ্গাও তার ব্যতিক্রম নয়…
আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা - অন্যরকম লড়াই শিবানীর
সেই স্মৃতি আজও টাটকা ভাওটিনার মনে। বারবার মনে হচ্ছিল ওই মানুষগুলোর জন্য কিছু করি, অস্ত্র ফেলে দিয়ে শান্তির পতাকা রাখি। কিন্তু তখন কিছুই ছিল না তাঁর। ২০১৫ সালে এআইইটি হওয়ার পর একটু জোর আসে। যতটুকু সামর্থ্য ছিল, তাই নিয়েই ছুটে যান দাঙ্গা বিধ্বস্ত জায়গায়। তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও ক্ষত তখনও দগদগে। বোদো-মুসলিম নয়, প্রত্যেককেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ভাওটিনারা। কারোর হাত কেটে গেছে, কারোর পা-ই উড়ে গেছে। কারোর আবার জমি চলে গেছে অন্য কারোর নামে। সবার জন্য এগিয়ে গেছেন তাঁরা। সঙ্গে নিয়ে গেছেন সেই অমোঘ বার্তা - ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। এসব করে কি আদৌ কিছু হবে? দিনের শেষে সবাই একসঙ্গে বসবাস করি। সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। জনে জনে এমনটা বুঝিয়ে গেছেন দিনের পর দিন। ভয়ের আবহ যতটা সম্ভব কমানো যায়, সেই চেষ্টা করতে লাগলেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে না হলেও, একটা সময় পর অবস্থা বদলাতে আরম্ভ করল। তাঁদের চেষ্টা ফল পেতে শুরু করল। সেটাই ছিল শেষ দাঙ্গা। নতুন করে হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটা কমে গেছে।
এইভাবে, এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, বিপদের আশঙ্কা করেন না? বাধার মুখে পড়েননি কোনোদিন? হেসে ওঠেন ভাওটিনা মুশায়রে। অচলায়তন ভেঙে পড়ার আগে ঠিক যেমন করে দুনিয়ার সব নন্দিনী হেসে ওঠে। “মেয়ে হওয়াই তো এই দেশে একটা বাধা। যেখানে প্রতি পদে শুনতে হয় ও তো মেয়ে, ও কী করবে! পরিবারে হোক বা কাজের জায়গা সব ক্ষেত্রেই এক বক্তব্য। আমাদের লোয়ার অসম এরিয়ায় মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত কোনো সংস্থা আগে ছিলই না। আমরাই প্রথম এমনটা শুরু করেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজে মাঝেমধ্যে অনেক রাতেও বেরোতে হয়। ফলে নানা সময় অশালীন মন্তব্য শুনতে হয়। সেজন্য অনেক মেয়েরাও কাজ করতে চায় না। কিন্তু চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হবে। না নিলে জিতব কী করে!”
প্রতিটা শব্দের মধ্যে এই শেষ লাইনটাই ফুটে উঠছিল বারবার। ‘না হলে জিতব কী করে!’ আসামের বন্যা যখন গোটা দেশ আর বিশ্বকে ভাবাচ্ছে, তখনও ভাওটিনারা পৌঁছে যাচ্ছেন বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে। সাধ্যমতো যতটা পারছেন সাহায্য করছেন। বাধা আসছে এখনও। কিন্তু পাহাড়ি নদী যে খরস্রোতা! এত সহজে যে তাঁকে থামানো যায় না…
Powered by Froala Editor