৭ জুলাই। ১৯৩০ সালের এই দিনটিতেই নির্ভীক চিত্তে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। ৯০ বছর পরেও, ভারতের স্বাধীনতার যজ্ঞে আহুতি দিয়ে অমর হয়ে রয়েছেন এই বিপ্লবী। জানেন কি, কৈশোরেই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়ে উঠেছিলেন ভানু-র কৈশোরের উপাস্য। যে ভানু পরবর্তীতে বাংলা সিনেমা-থিয়েটারে কমেডির কাল্ট হয়ে উঠবেন, তিনি বিলি করতেন বিপ্লবী সংগঠনের প্রচারপত্র, তাও গুপ্ত-সমিতিগুলির মতোই গোপনে।
সাম্যময় ওরফে ভানুর দিদি প্রকৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন লীলা রায়ের স্বদেশি দল ‘জয়শ্রী পার্টি’র সদস্যা। আর সেই সমিতিতেই দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয় ভানু-র। সেই থেকেই ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। ‘দীনেশ দা’র সাইকেলে চেপে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন ভানু। এমনকি ‘দীনেশ দা’র আদেশে ঢাকার সদরঘাটে ‘স্পাই’-এর কাজও করতেন। ভানু-র দায়িত্ব ছিল সদরঘাটে কোথায় কোন পুলিশ যাচ্ছে, কে আসছে, টাঙ্গা চড়ে কোনদিকে চলে যাচ্ছে ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ দীনেশ গুপ্তকে জানানো। ঢাকাইয়া গাড়োয়ানের পাশে বসে টাঙ্গা চেপে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে অনুসরণ করতে করতে আঞ্চলিক ‘কুট্টি ভাষা’টিও রপ্ত করে ফেলেন ভানু। পরে ১৯৪৩ সালে ‘ঢাকার গাড়োয়ান’ নামে তাঁর কমিক স্কেচের রেকর্ড বেরোয়, যা পরোক্ষে দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্যেরই ফলশ্রুতি। এই অশিক্ষিত কুট্টিদের ‘সেন্স অফ হিউমার’ই যে তাঁকে কমেডিয়ান হতে প্রেরণা জুগিয়েছিল তা অকপটে স্বীকার করেছেন ভানু।
আট-নয় বছর বয়স থেকেই দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্যে এসেছিলেন বালক সাম্যময় ওরফে ভানু। এই দীনেশদা-র সঙ্গেই দেখেছেন বহু সিনেমা – লন চ্যানির ‘হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম্’, চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’। আর তাছাড়া লরেল হার্ডি, বাস্কার কিট্ন, হ্যারি ল্যাংডনের ছবিগুলি ভানুকে কমেডির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল যা সবই দীনেশদা-র সঙ্গেই দেখা। ‘আত্মকথা’য় ভানু জানাচ্ছেন যে, সেই কৈশোরেই স্বামীজির অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মুখে তিনি শুনেছিলেন সেই অতিচর্চিত কাহিনিটি। পাঞ্জাবে একটা মিটিংয়ে যেতে গিয়ে সাইকেলের চাকা ফেটে গেলে দীনেশ গুপ্ত নাকি সেই সাইকেল কাঁধে করে চার মাইল রাস্তা দৌড়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলেন মিটিংয়ে। অনুশীলন সমিতির ত্রৈলোক্য মহারাজ, রাধাবল্লভ গোপ, মাস্টারদা, লোকনাথ বল প্রমুখদের কথা দীনেশদা-র মুখে শুনতে শুনতে দেশভক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল কিশোর ভানুর হৃদয়ে। ঢাকা শহরে দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে ঘুরতেন বলে ভানুকে মানুষ অতিরিক্ত সমীহও করত। সেই দীনেশ গুপ্ত, ভানুর আইডল দীনেশদা মারা যাবার পর স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলেন ভানু। পড়াশোনায় মনোনিবেশের চেষ্টা করতেন।
৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৮-তে বিনয়-বাদল-দীনেশের স্মরণসভা হচ্ছে মহাকরণে। এক আধুনিক নেতার বক্তৃতায় হঠাৎ শুনলেন ফাঁসির আগে দীনেশের নাকি ওজন বেড়ে গিয়েছিল! আর ঠিক এই ঘটনাপ্রসঙ্গে ‘আত্মকথা’য় ভানু লিখছেন, ‘…অথচ একবারও বললেন না, জেল থেকে লেখা দীনেশদার চিঠিগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করা উচিৎ। এগুলোর মাধ্যমে উত্তরসুরিরা জানতে পারত কী জাতের দামাল ছেলেরা সেইসময় বাংলায় জন্মেছিল।’ পরবর্তীকালে ভানুর একরোখা চরিত্রের আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। সারাজীবন ধরেই একপ্রকার ‘প্রতিবাদী’ সত্তা নিজের মধ্যে বহন করেছিলেন ভানু। সেই স্বভাব কি আয়ত্ত হয়েছিল কৈশোরে বিপ্লবী-সঙ্গের ফলেই?
আরও পড়ুন
টালিগঞ্জে 'ব্রাত্য' ভানু, সংসার চালাতে করেছেন যাত্রাও!
Powered by Froala Editor