জেলবন্দি অনন্ত সিংহকে মেয়ের বিয়ের ভোজ পৌঁছে দিয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৭৯ সালে একটা সাক্ষাৎকারে সাম্যময় ওরফে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে মতামত চাওয়া হলে কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন - ‘That I am a Communist, I bear it in my name.’

মৃত্যুর বছর চারেক আগে এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন তিনি। সাম্যময় নামটা রেখেছিলেন তাঁর মাতামহ, তাই মজা করে বলতেন, গড়পড়তা লোকের চেয়ে কমিউনিজমটা তিনি একটু বেশিই বোঝেন। কিন্তু আপাত সরল মজা হলেও কিশোর বয়স থেকে বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যে মানুষটি, তাঁর জীবনভর নানা কাজের মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা যুক্ত। আমাদের বিশ্বাস এবং আস্থা নির্ভর করছে কার্ল মার্কস কথিত নিম্নোক্ত বাক্যের ওপর - ‘শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধনমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হল রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া।’

ভানুর বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকা রাজ-এস্টেটের মোক্তার। মা সুনীতি দেবীও সরকারি চাকুরে ছিলেন, যা সেইযুগে একপ্রকার ভাবা অসম্ভব। ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা দপ্তরে জেনানা গভর্নেস পদে কর্মরত ছিলেন। ফলে, বাড়ির পরিবেশ ছিল প্রগতিশীল। কিন্তু বাবা-মা দুজনেই সরকারি চাকুরে হওয়ায় বিপ্লবী-সঙ্গ একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু শৈশবের নামকরণেই যার মতাদর্শের গতিপথ নির্ধারিত হয়ে আছে, কৈশোরের উত্তেজনা তাঁকে আটকে রাখবেই বা কীকরে! দীনেশ গুপ্তর সাইকেলের পেছনে বসে গ্রামে গ্রামে ঘোরা, লুকিয়ে বিপ্লবীদের গুপ্তসমিতিতে যাওয়া, তারপর বাবার বকুনি শুনে পাল্টা বলে ওঠা - ‘এসব মিটিংয়ে কেউ যদি নাই যাবে - তবে অমন মিটিং হয়ই বা কেন?’

ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালে ডাক্তারির ছাত্র বিনয় বসু-কর্তৃক কুখ্যাত আইজি প্রিজন লোম্যান-হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ, রোমহর্ষক বিবরণ ভানু নিজেই লিখে গিয়েছিলেন। যে বাঙালি কন্ট্র্যাক্টর পলায়নরত বিনয়কে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতালের মাঠে জাপটে ধরেছিল, বিনয়ের বলিষ্ঠ ঘুঁষিতে তার দাঁতের ‘অকালে খসে পড়া’র ঘটনা তিনি লিখেছেন সেখানে। হাসপাতালের মেথর সুষেন পাঁচিলের ছোট্ট দরজা খুলে তাঁর ‘বিনয়দা’কে পালাতে সাহায্য করেছিল, পরে পুলিশের অকথ্য অত্যাচারেও সে মাথা নোয়ায়নি। ‘সাধারণের চোখে ছোটলোক’ এই মানুষটির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ঝরে পড়েছে। দীনেশ গুপ্তর ফাঁসির পরদিন ভানু দেখেছেন, ঢাকার কুখ্যাত গুণ্ডা ভোলা মিঞা, যাকে অসামাজিক কাজের জন্য বেদম পেটাতেন দীনেশ গুপ্ত ও তাঁর ছেলেরা, দীনেশের মৃত্যুতে সেই লোকটাই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে।

সাহচর্য পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ছোটভাই, এদেশে কমিউনিজমের অন্যতম পথিকৃৎ ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তেরও

তিরিশের দশকের ওই টালমাটাল সামাজিক সময়, বাংলা তখন সংস্কৃতি ও সংগ্রাম, দুই ক্ষেত্রেই সারা দেশের পথপ্রদর্শক। একই সময়ে ঘটে গেছে চট্টলা অস্ত্রাগার দখল। ভানুর জন্মশহর ঢাকায় তখন সংস্কৃতি জগতের দিকপালরাও সমান সক্রিয়। ভানুর বেড়ে ওঠার এই পর্বটি তাঁর পরবর্তী জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। ঢাকার বিপ্লবীদের মধ্যে বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত ছাড়া কেদারেশ্বর সেনগুপ্ত, রমেনচন্দ্র আচার্য, ননী ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ মুখার্জী, রাধাবল্লভ গোপ, মাখন পাল প্রমুখদের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সাহচর্য পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ছোটভাই, এদেশে কমিউনিজমের অন্যতম পথিকৃৎ ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তেরও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. পড়তে এসে শিক্ষক হিসাবে পেলেন কবি জসীমউদ্দিন, মোহিতলাল মজুমদার, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে। হাস্যকৌতুক সৃষ্টির ক্ষমতা ছিল তাঁর সহজাত। কিন্তু একই সময়ে তিনি হয়ে উঠছেন উল্লেখযোগ্য ছাত্রনেতা। সেলুলার জেলের অন্ধকার থেকে রাজবন্দিদের ফিরিয়ে আনতে শুরু করছেন আন্দোলন, যোগ দিচ্ছেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের দ্বারা গঠিত নতুন বামপন্থী সংগঠন রেভোলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি বা আর. এস. পি.-তে, তারপর একসময় রাজরোষে পড়ে একবস্ত্রে ঢাকা ছেড়ে চলে আসছেন কলকাতায়, সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও।

পরবর্তীকালে অভিনয়-জগতের সদাব্যস্ত একজন কর্মী। একইসঙ্গে চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রাপালা, কৌতুক নকশার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ব্যস্ততার মাঝেও বিপ্লবীদের মৃত্যুদিন বা জন্মদিনে তাঁদের ছবিতে মালা দিতে মহাকরণে যেতেন। প্রতি জন্মদিনে সত্যেন বসুর জন্যে মিষ্টি নিয়ে যেতে ভুলতেন না। তবে জন্ম বা মৃত্যুদিনেই ফুল-মিষ্টি দেওয়া চিরাচরিত ‘একদিনব্যাপী’ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে তিনি নিজেকে সার্থক করার রাস্তায় হাঁটেননি। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়ানোর আজীবন সংগ্রামী মনোভাবে বিরাট ঝুঁকি নেওয়ার দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে খাদ্য-আন্দোলনে পীড়িত মানুষদের সাহায্যার্থে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, অজিত লাহিড়ী, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, সৌম্যেন্দু রায় প্রমুখ শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে যে মানুষটি ত্রাণ সংগ্রহের পুরোভাগে ছিলেন, তাঁর নাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেতৃ সঙ্ঘের সঙ্গে সিনে টেকনিসিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের আন্দোলনকে যুক্ত করার পেছনেও ছিলেন এই স্পষ্টবক্তা মানুষটি। প্রোডিউশার ও হল মালিকদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন তাঁরা। ১৯৬৭ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন অভিনেতৃ সঙ্ঘ কলাকুশলী-প্রযোজকদের আন্দোলনে মুনাফাখোর প্রযোজকদের বিরুদ্ধে কলাকুশলীদের পক্ষ নিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে ব্ল্যাক-লিস্টেড হওয়ার হুমকিকেও হেলায় সরিয়ে যাত্রামঞ্চে নিজের জীবন ঢেলে দিতে দেরি করেননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘শিল্পীরা তো শ্রমিকই’ নিবন্ধে একবার লিখেছিলেন-“আমরা বিশ্বাস করি যে, দেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে আমরা শিল্পীরা একটি সংগঠিত সংস্থা হিসেবে আলাদা থাকতে পারি না। ...তার কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক অবস্থা যুক্ত। আমাদের বিশ্বাস এবং আস্থা নির্ভর করছে কার্ল মার্কস কথিত নিম্নোক্ত বাক্যের ওপর-‘শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধনমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হল রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া।’”

ভানুবাবুর অন্তরে দেশপ্রেমের আগুন প্রজ্জ্বলিত আছে।

- অনন্ত সিংহ

চট্টলা বিদ্রোহের অন্যতম বিপ্লবী অনন্তলাল সিংহের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। তাঁর আদর্শ, কর্মকাণ্ড ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। সখ্যতা গড়ে ওঠে তাঁর সঙ্গে। অনন্ত সিংহ পরে তাঁর বেশ কয়েকটি ছবি প্রযোজনাও করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘সখের চোর’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘শেষ পরিচয়’ ইত্যাদি। এর মধ্যে কয়েকটি ছবিতে শুধুমাত্র অনন্তের সম্মানে বিনা পারিশ্রমিকেও কাজ করে দিয়েছিলেন ভানু, যিনি কিনা কৌতুকাভিনেতাদের ‘লোক-হাসানো অভিনেতা’ তকমায় অভিহিত করা হতো বলে বরাবর যোগ্য সম্মান ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক দাবি করে বহু প্রযোজকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। অনন্ত নিজেও অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ভানুর সম্পর্কে, বলতেন - ‘ছায়াছবির মাধ্যমে সামাজিক দুষ্কর্ম, সরকারের অক্ষমতা ও তথাকথিত নেতাদের প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর শ্লেষপূর্ণ ও বিদ্রুপাত্মক অভিনয় যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলবেন, ভানুবাবুর অন্তরে দেশপ্রেমের আগুন প্রজ্জ্বলিত আছে।’

১৯৭০-এর দশকে অনন্ত সিংহ বেশ কিছু ব্যাঙ্ক ডাকাতির কারণে গ্রেপ্তার হন। তাঁর মতো বিপ্লবীর এহেন কাজ অনেককেই ব্যথিত করেছিল। সেসময় ভানুর কাছে এক সাংবাদিক অনন্ত সিংহকে ডাকাত বললে ভানু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তাঁকে গালাগাল দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। অনন্ত সিংহ তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। ভানুর মেয়ে বাসবীর বিবাহ সম্পন্ন হল। মেয়ের বিয়ের ভোজ নিজের হাতে জেলবন্দি অনন্তের জন্য পৌঁছে দিয়েছিলেন ভানু।

Powered by Froala Editor