১৯৮২ সালে ভারতে সাড়া ফেলে দিয়েছিল একটি সিনেমা। ‘গান্ধী’। মহত্মা গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বেন কিংসলে। তবে এতটুকুও সূক্ষ্ম ফারাক ছিল না তাঁর গান্ধীজীর সঙ্গে। পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবরোর সেই সিনেমা মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পরেই জীবন্ত করে তুলেছিল গান্ধীজীকে। তবে ভারতীয় পোশাক ডিজাইনার ভানু আথাইয়া না থাকলে হয়তো সম্ভব হয়ে উঠত না তা। গান্ধীজীর রূপদানের জন্য প্রথম ভারতীয় হিসাবে তিনিই বিশ্বের দরবারে সম্মানিত হয়েছেন অস্কার পুরস্কারে। অবশেষে জীবনাবসান হল ভারতের সেই প্রথম অস্কার বিজয়ীরই।
বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ের বাড়িতেই প্রয়াত হন ভানু আথাইয়া। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বছর আটেক আগেই মস্তিকে ধরা পড়েছিল টিউমার। অসুস্থতা ছিলই। বার্ধক্যজনিত কারণে সম্ভবও হয়নি অপারেশন করিয়ে ওঠা। তার ওপরেই পক্ষাঘাতে একদিক অচল হয়ে গিয়েছিল তিন বছর আগে। যার কারণে শেষের দিনগুলো শয্যাশায়ী হয়েই কাটছিল তাঁর। সেখান থেকেই মুক্তি পেলেন আথাইয়া।
মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর শহরে ১৯২৯ সালে জন্ম আথাইয়ার। বাবা ছিলেন একজন চিত্রকর। মাত্র ৯ বছর বয়সেই তাঁকে হারান আথাইয়া। সাত ভাই-বোনের সংসারে টানাপোড়েন ছিল বেশ। তাই আর সুযোগও হয়ে ওঠেনি ডিজাইনিংয়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথাগত শিক্ষালাভের। তবে শিল্প, সৃজনীর ক্ষেত্রে তাঁর কাছে অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর বাবাই। নিজের উদ্ভাবনী শক্তিকে দৃঢ় করেছেন তিনি নিজেই।
১৯৫৬ সাল। ২৭ বছর বয়সে প্রথম সুযোগ এসেছিল প্রমাণ দেওয়ার। গুরু দত্তের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘সিআইডি’-তে প্রথম কস্টিউম ডিজাইনারের কাজ করলেন আথাইয়া। বলাই বাহুল্য, সেই সিনামার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ ছোঁয়া। কার্যত তারপরেই ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। গুরু দত্তের দলে পাকাপাকিভাবেই জায়গা করে নেন তিনি। ‘পিয়াসা’, ‘সাহেব বিবি অওর গুলাম’, ‘চৌদভিন কা চাঁদ’ প্রভৃতি গুরু দত্তের একাধিক সিনেমার সাফল্যের অন্যতম ভাগীদার ছিলেন তিনি।
সব মিলিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ১০০টিরও বেশি সিনেমায়। যার মধ্যে রয়েছে ‘কারজ’, ‘গীতা মেরা নাম’, ‘অগ্নিপথ’, ‘পরম্পরা’, ‘লেকিন’, ‘লগান’, ‘স্বদেশ’ ইত্যাদি বিখ্যাত চলচ্চিত্র। ১৯৮২ সালেই জুটল তাঁর কাজ এবং দক্ষতার যোগ্য মূল্য। ভারতের মাটিতে প্রথম এল অস্কার। সত্যজিৎ রায় তখনও পরেননি শ্রেষ্ঠত্বের এই মুকুট। ১৯৯১ সালে ‘লেকিন’ এবং ২০০২ সালে ‘লগান’ চলচ্চিত্রের জন্য আথাইয়া দু’বার সম্মানিত হয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কারে। ২০০৯ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন চলচ্চিত্র সম্মানেও ভূষিত হন আথাইয়া।
তবে এসব কিছুর পরেও নির্জনে থাকতেই পছন্দ করতেন তিনি। স্রেফ ভালোবাসা থেকেই চালিয়ে গিয়েছিলেন নিজের ডিজাইনিংয়ের কাজ। চাইলেই বড়ো ব্যবসাও করতে পারতেন পাশাপাশি। তবে সেসব আর করে ওঠেননি তিনি। এমনকি চলচ্চিত্র জগতের সবথেকে বড়ো সম্মান অস্কারের স্মারকও ২০১২ সালে অ্যাকাডেমিতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আথাইয়া। তাঁর বক্তব্য ছিল এই মূল্যবান স্মারক কোনোভাবেই তিনি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছেন না। এমনই সহজ এক ব্যক্তিত্ব ভানু আথাইয়া। তাই এই নিঃশব্দ চলে যাওয়া খুব একটা অবাক করে না সকলকে। শুধু ঠেলে দেয় এক গভীর শোকস্তব্ধতার মধ্যে।
আরও পড়ুন
প্রয়াত প্রাক্তন বিধায়ক ও মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, শোকের ছায়া রাজনৈতিক মহলে
২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বই ‘দ্য আর্ট অফ কস্টিউম ডিজাইনিং’। প্রথাগত শিক্ষা না থাকার পরেও ডিজাইনিংয়ের এক কমপ্লিট ক্লাসই যেন নিয়েছেন সেখানে আথাইয়া। ব্যক্তিগত জীবনেও তো নতুনদের সবটুকু ঢেলে দেওয়ারই চেষ্টা করেছেন তিনি। ফাঁকা হয়ে গেল চলচ্চিত্র জগতের সেই অভিভাবকের জায়গাটাই...
Powered by Froala Editor