মেট্রোটা চাঁদনী চক আসার আগে থেকেই আমার বয়সটা কেমন জানি কমিয়ে দেয়। কারণ তার পরেই তো সেন্ট্রাল-মহাত্মা গান্ধী রোড-গিরিশ পার্ক—শোভাবাজার-শ্যামবাজার অতএব কলেজ স্ট্রিট, কলেজপাড়া, হাতিবাগান, বাগবাজার—এইখানেই তো কাটিয়েছি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো। আজও বাসে, ট্যাক্সিতে, মেট্রোতে এই জায়গাগুলো পেরোলে এখনও হুট করে মনে পড়ে যায় কিছু কিছু ভাঙাচোরা মুহূর্ত। যেমন এই তো সেদিন স্কটিশের পেছনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতেই একটা সিগারেটের দোকান দেখে মনে পড়ে গেল কলেজে সুমিত স্যারের একটা কথা। সুমিত স্যারের ব্যাপারে কিছুটা বলে রাখি, ইনিই একমাত্র অধ্যাপক যার জন্য আমি মুখিয়ে বসে থাকতাম ক্লাস করব বলে। বাকিরা তো বেশিরভাগই ছাপ্পা মারা অধ্যাপক। কত নম্বর পেতে হবে, নোটস জেরক্স করে নাও, কমন কোয়েশ্চেনগুলো টুকে নাও—শুধুই এইসব। এই মেশিন বানানোর কারখানার মধ্যে সুমিত স্যার ছিলেন আমার কাছে ‘হাঁফ ছাড়া প্র্যাকটিস’ করানোর মাস্টারমশাই। উনি কোনোদিন সিলেবাস, নোটস, টেক্সট বইয়ের ধার ধারেননি, সব সময় গল্প করে করে কঠিন জিনিস বুঝিয়ে দিতেন। তিনি একবার স্বর্ণ বণিকদের ব্যাপারে বলতে বলতে বলেছিলেন—‘কলেজের পেছনে এই জানলা দিয়ে দেখ ওইদিকটায় যে পান সিগারেটের দোকানগুলো আছে না? মানে যেখান থেকে সদীপ সিগারেট কিনিস, ওই জায়গাগুলো একটা সময় সব স্বর্ণ বনিকদের আড্ডা ছিল।’ আজ প্রায় দশ বছর পরও অবিকল স্বর্ণবণিকদের ব্যাপারে মনে আছে কিন্তু। পড়ানোর মতো বড় শিল্প আর হয় না। ওই-ই প্রথম যে বিষয়টা নিয়ে পড়তে ঢুকেছি সেটাকে ভালবাসতে শিখলাম, এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেটাও ছিল বসন্তকাল।
‘বসন্ত’কাল-ই বটে। দুপুরে ক্লাস শেষ হলেই খিদে পেলেই হেঁদুয়ার ব্লসমের রোল নয়তো বসন্ত কেবিনে মোগলাই কিংবা পরোটা মাংস। আমরা আবার জগৎমাতাতেও যেতাম, মেঝেতে বসে পাত পেড়ে কাঁসার থালায় ভাত, সুক্তো, পোস্ত ইত্যাদি ইত্যাদি খেতে। আমাদের সময়ে অনেকেই বসন্ত কেবিনের নামে নাক সিঁটকোলেও আমরা কয়েকজন তখনো বসন্ত কেবিনে যেতাম। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে ওপরে পর্দা দেওয়া কেবিন। পুরনো ক্যাফেগুলোয় কেবিন দেখলেই লজ্জা পেতাম। হয়তো ছোটোবেলায় বাবা মায়ের সঙ্গে কোনো এরকম ক্যাফেতে গেছি আর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে পর্দা সরিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলেই সব্বাই কীরকম জানি মুখ তুলে চেয়ে থাকত তাদের দিকে। সেটাই মজ্জাগত হয়ে গেছিল আর কি। কেবিনে না বসলেও নিচে পাথরের টেবিল টপে কনুই রেখে বসে কত যে মাংস মাছ খেয়েছি আর ইয়ত্তা নেই। একবার মনে আছে সদ্য রাজনীতি করছি, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে মিছিল নিয়ে এসে জমায়েত করার সময় আইন অমান্য করব জেনেই পুলিশের হুমকি না শুনতেই প্রচণ্ড মার খেয়ে লক আপে গেলাম কয়েক ঘণ্টার জন্য। এর আগে দুবার লক আপ অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। এবারের বন্দি অবস্থাতেও নিজেকে যেন হেব্বি স্বাধীন মনে হয়েছিল যখন আমার পছন্দের মেয়েটা আমার পাশে বসেই বলে উঠল—ছাড়া পেলে বসন্ত কেবিনে যাবি? খিদে পেয়েছে খুব। এসব সময়ে ‘না’ বলার মতো কচি খোকা আমি নই। কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে বসে কি খেয়েছিলাম মনে নেই তবে মেয়েটার কোনও কথাই শুনিনি সেটা বিলক্ষণ মনে আছে। শুধু এইটুকু কানে এসেছিল—‘হেগেল আর মার্ক্স…’ আমি শুধু নজর করে গেছি তার ভুরু উঠিয়ে কথা বলা, চোখের নিচে ঘামে ভেজা দুটো গালে অল্প ব্রণ আর চুলের ঘনত্ব। সেদিনের আড্ডার পর মেয়েটা আমায় খুব মনোযোগী শ্রোতার শিরোপা দিয়েছিল। প্রেম হয়েছিল তার সঙ্গে আমার। প্রেমের বোধ জন্মেছিল ‘বসন্ত’-এই।
বসন্ত মানেই কি ফুল, নতুন গাছের পাতা, নাতিশীতোষ্ণ আমেজ আর প্রেম প্রেম উড়ো হাওয়া? সেসব তো বটেই। কিন্তু তার সাথে আরেকটা জিনিস খুব জড়িয়ে আছে আমার সঙ্গে বাগবাজার ঘাটে বসে বহু রাত অবধি আড্ডা দেওয়া। রবার্ট ব্রেসোঁ-র ছবি ‘আউ হাজরাদ বালথাজার’ দেখার পর বন্ধুদের ছবিটা সম্পর্কে অনেক অনেক বকবক করে বিরক্ত করেছিলাম বাগবাজার ঘাটেই। প্রেম ভেঙে গিয়ে একা ক্রমাগত ট্রেনের হর্ন শুনতে শুনতে নিজের ঘোরে বিভোর থেকেছি বাগবাজারের ঘাটেই। কলেজে বৈষ্ণব পদাবলী পড়ানো হচ্ছে আর এদিকে আমার হৃদয়ের কিমা দিয়ে বন্ধুরা রুটি খাচ্ছে রোজ। এরকম সময়েও পদের বিশ্লেষণ পড়েছি ঘাটে বসেই সঙ্গে ছিল সত্য গিরি-র বৈষ্ণব পদাবলীর ব্যাখার বই। টুপ করে বিদ্যাপতির লেখার ওপর এসে একটা অমলতাস পড়ল। এইতো সেদিন বইয়ের আলমারি মুছতে গিয়ে সেই বইয়ের পাতা থেকেই ফুলটা পেলাম আবার। শুকিয়ে গিয়ে কালো হয়ে গেছে। ফুলটা দেখতে গিয়ে বিদ্যাপতির পদটা পড়া হয়ে গেল আবার—
“আএল ঋতুপতি রাজ বসন্ত।
ধাওল অলিকুল মাধবি-পন্থ।।”
বসন্ত আমায় শিখিয়েছে জাপানে চেরি ব্লসম ঝরলেও আমাদের এখানে রাস্তা ভরে থাকে রঙ্গনে রঙ্গনে আর অমলতাসের হলুদে। জলরঙে তাদের এক করে দিয়ে উপহার দিয়েছি প্রিয় কাউকে। এখনও সে আঁকা লেক মার্কেটের একটা বাড়ির দোতলায় জানলা দিয়ে দেখা যায়, কী জানি কেন আজ সে বাড়িতে ঢোকা মানা। বয়স বেড়েছে, দায়িত্ব কাঁধে চেপে কানে কানে বলেছে— বিষয়কে বিষ বলে এড়িয়ে যাবে ভেবেছ? তোমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছি বুঝবে ঠেলা! আমিও মানুষ হয়েছি বলা চলে। কলেজ স্ট্রিট এখন আপন পাড়া আর নয়, মাঝে সাঝে দরকারে নিয়ম করে বই কিনতে যাওয়া হয়। কফি হাউজে অথবা রমানাথে আড্ডাও হয় পরিচিত মুখ ডাক দিয়ে উঠলে। রমানাথ থেকে হুজুগ উঠল বসন্ত কেবিনে যাওয়া হবে, হলও তাই। কে জানত এখানেই বসন্ত আমায় প্রতিদান দেবে বলে প্ল্যান করে রেখেছে? এক বিদেশিনীকে চিনিয়ে দিল কেবিন আর আমিও ট্রামে, পায়ে হেঁটে তার সঙ্গে ভারী ভারী প্যাকিং বাক্স হাতে নিয়ে স্পেন পাঠাচ্ছি জিপিও থেকে। প্রেম হয়েছিল আবারও। আবারও ভাঙন ছাড়াই ছেড়ে দিতে শিখলাম পছন্দের কাউকে দূরে। আটকাতে নেই প্রিয়দের। তারা দূরে যাবে আরও দূরে আর দূর থেকে তারা আমাদের দূরত্ব টের পেয়ে মন খারাপ করবে—অগোচরে বেঁচে থাকবে ভালোবাসা। বিদেশিনী চলে গিয়েছিল সেই ফেব্রুয়ারিতেই। এয়ারপোর্টে যাইনি আমি, বসেছিলাম ফোন বন্ধ করে বোকার মতো অভিমানী একটা কারখানার সিঁড়িতে। দুটো ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছিল ঘাড়ে আর হাতে। ওপরে তাকিয়ে দেখি কারখানার ছ্যাদা ছাদ থেকেও স্পষ্ট দেখা গেল আকাশ গর্জিয়ে একটা দাম্ভিক উড়োজাহাজ উড়ে গেল, তার কি একটুও মায়া হয়নি?
সাময়িক কালে আর বসন্তের আনাগোনা টের পাই না বোধহয়, এমনটাই ধারণা নিয়ে মন বেজার হয়ে ছিল। ক্যাবালি আমি এখনও এড়িয়ে যাই না। একটা মেয়ের আমাকে ভালোলাগছিল বোধহয়। ছলে বলে আমাকে জিজ্ঞেস করল—আমাকে তুই কি হিসেবে দেখিস? আমিও হুট করে বলে ফেললাম—দিদি? আমার আর কোনোদিন প্রেম হবে? দিদি মনে হলেও কেউ নিজের মুখে বলে কথাটা? সেদিন সেই মেয়েটার সঙ্গেই রিক্সায় উঠে অনতিদূরেই যেতে হয়েছিল। রিক্সায় উঠতেই কেমন জানি তার শরীরে একটা আপন গন্ধ পেলাম। এসব গন্ধ ছড়িয়ে রাখে অপরাধবোধ তাদের সর্বত্র। টান অনুভাব করলাম। রিক্সা চলেছে, এলোপাথাড়ি গুঁড়ো ফুল এসে পড়ছে আমাদের কোলে-জামায়। হাওয়ায় হাওয়ায় একটা হালকা মনখারাপ। আমার কান মুলে বসন্ত বুঝিয়েছিল আমি ভালোবাসি। ভালোবাসার আশ্বাস আজও ঠোঁটে এনে কাউকে ক্ষণিকের জন্য বিশেষ অনুভব করাতে পারি। আমিই তো সেই ছেলে যার ‘বসন্ত’কেবিনে অনারস আর পাস সাবজেক্টে বিদ্যাপতি। আমিই তো সে, যার একবুক ভর্তি জায়গা আছে নতুন অফুরন্ত স্মৃতি জমিয়ে রাখবার… আমিই তো সে যে ভালোবেসে ফেললাম আবার…
Powered by Froala Editor