ফোঁটা পুনরুদ্ধার প্রকল্প

১.
'ভাইফোঁটার পিতৃতান্ত্রিকতা' নিয়ে বখেড়াটা যে অনেকদিন ধামাচাপা ছিল, তার কারণ একে ঘিরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষেরই আছে মধুর নস্টালজিয়া। বাঙালি চেতনার সাদা-কালো জুড়ে অপু-দুর্গার ছুটে বেড়ানো। আমাদের কবিতায় মেয়েটি বলে, 

“ওপারেতে বৃষ্টি এলো ঝমঝম করে
গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে!”

শ্বশুরবাড়িতে যে মেয়ের মন কেমন করে, ভাই তার ফেলে আসা ঘর-দোরের প্রতিভূ বলেই স্নেহপুত্তলি, প্রিয়তর৷

আপামর ভারতবাসীর ভ্রাতৃত্ব উৎসব রাখিবন্ধন। সেখানে বোন রক্ষণীয়া। সুতোটি বাঁধা হয় ভাইকে রক্ষার দায়িত্ব মনে করাতে। অন্যদিকে ভাইফোঁটায় ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় বোনের চন্দনটিপ। সেখানে পৌরুষের কম, স্নেহের প্রকাশ বেশি। কিন্তু বোনের মঙ্গলকামনার উদযাপন যে দূর অস্ত! অর্থাৎ, উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও, দুটিই পিতৃতন্ত্রের দুই ভিন্ন প্রকাশ।

তা সত্ত্বেও কিছু অনাবিল সুখানুভূতিকে এমনভাবে লালন করে মানুষ, যেমন মা যত্ন করে ভ্রূণ। তেমন সুখানুভবের দোষ ধরায় তার অনীহা, কাটাছেঁড়ায় ভয়। নস্টালজিয়ার তাই দায় নেই ঐতিহাসিকতার। 'নস্ট্যালজিক' আর 'হিস্টোরিক' তাই প্রায়শই বিপ্রতীপে দাঁড়ায়। ভাইফোঁটার নস্টালজিয়াতেও কোনো ঐতিহাসিক সত্য হারিয়ে যায় নিশ্চয়। বোনফোঁটার উদ্যোগে কি সেসবের স্খালন হয়?

২.
নিজের কথা যদি বলি, তবে উপোস করে ভাইফোঁটা দেওয়ার কোনো স্মৃতি নেই৷ চন্দন বাটার বা দুব্বো তোলারও নেই৷ ছোটবেলা থেকে আমাদের ভাইফোঁটায় কেন্দ্রীয় আকর্ষণ ছিল উপহার৷ পরস্পরের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে বলা, 'আমার পছন্দ ওটা, কিনে দে'। এসব সেই টিফিনবাক্স-ওয়াটারবোতল আদানপ্রদানের দিন থেকে শুরু হয়ে ঈষৎ গম্ভীর বইপত্র কেনার সময় পর্যন্ত চলেছিল৷ ছোটোবেলায় 'শুকতারা'-য় ফি বছর হিঁদু বোন মুসলমান ভাইকে ফোঁটা দিচ্ছে, এই মর্মে গল্প বেরোত৷ বামপন্থী মহিলারা কমরেডদের ফোঁটা দিতেন৷ সব মিলে, বেশ পৌরহিত্যের তোয়াক্কা না করা এক সাবলীল উৎসব মনে হত একে, যাকে পুজো-আচ্চা না বলে লোকাচার বলাই ভাল। 

তারপর বোঝা গেল পিতৃতন্ত্রের জারিজুরি৷ বাড়ির মেয়েটির সুরক্ষা নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়, তার দীর্ঘজীবনের কথা ভেবে কেউ স্নান সেরে শুদ্ধাচারে যত্ন করে মন্ত্র পড়ে না, মঙ্গলশঙ্খ বাজে না, থালায় প্রদীপের শিখা নিবু নিবু হলে সলতে উসকে দেয় না কেউ। সুতরাং ওসব বন্ধ হল৷ এ-ধরনের পারিবারিক সম্মেলন এড়ালাম।

আমাদের চেনা-জানা ভাইফোঁটা-পালানোর গল্পগুলিও ছিল সরেস। সম্ভাব্য প্রেমিককে নিরস্ত করতে মেয়েরা ফোঁটা দেওয়া বা রাখি পরানোর মোক্ষম চালটি ব্যবহার করত। কখনও ছলে-বলে আত্মীয়রা এই পন্থায় ভাই-বোন পাতিয়ে দিত ছেলে-মেয়ের মধ্যে, যদি সে প্রেমে তাদের সম্মতি না থাকত। প্রেমিক-পরিচয়াভিলাষী তাই পালিয়ে বাঁচতে চাইত। পরে, আরেক রকম ভাইফোঁটা-পালানোর কথা শুনেছিলাম। পাশের পাড়ার বিভাসকে ভাইফোঁটা আর রাখির দিন কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যেত না। শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে বিভাসের দিদি খুঁজে হন্যে হত ফি বছর। দূরের কোনো ছায়াহীন পার্কে বা নিস্তরঙ্গ পুকুরের ধারে একলা বসে থাকত বিভাস। দিদিকে সে ভালোবাসত বটে, কিন্তু সে দিদির 'বোন' হতে চেয়েছিল। বয়ঃসন্ধি থেকে ভাইফোঁটা এলেই অপছন্দের শরীরের কানে কানে তার সুপ্ত ইচ্ছা বলত, 'পালাও।'

৩.
ইদানীং জানলাম, ভাইফোঁটার দিনটিকে রিক্লেইম করা শুরু হয়েছে। কোথাও ভাই, বোনের কপালে আঁকছে ফোঁটা। সে হল প্রথম রকমের রিক্লেইমিং। আবার কোথাও বোনেরা নিজেরাই নিজেদের মঙ্গলকামনা করছেন ফোঁটা বিনিময় করে। এমনকী বোনফোঁটার মন্ত্রও লেখা হয়ে গেল। স্বাতী ভট্টাচার্যর মন্ত্রটি ছিল মায়াভরা —

‘শিশিরজলে চন্দনবাটা
বোনের কপালে দিলাম ফোঁটা
বোনের হবে সকল ভাল
বোন করবে জগৎ আলো
যমুনা যমের প্রিয় অতি
আমার বোন চির-আয়ুষ্মতী।

পুনশ্চ: বোন-এর পরিবর্তে সই বললেও দিব্যি লাগসৈ হয়।’

তৃষ্ণা বসাক লিখলেন সরস ছড়া —

'বোনের কপালে দিলাম ফোঁটা ।
ভায়েরা প্লিজ দিও না খোঁটা।।
যমুনাকেও দিলাম ফোঁটা ।
যম দেখে ভয়ে কাঁটা!' ...ইত্যাদি।

উপরের ছড়াকারদ্বয়, বোঝাই যায়, তাঁদের বোনফোঁটাকে দেখেছেন ভগিনিত্বের, বা নারীতে নারীতে সিস্টারহুডের উদযাপন হিসেবে। নাহলে তো বোনফোঁটার মন্ত্র কোনো পুরুষই লিখতেন! এ হল রিক্লেইমিং-এর দ্বিতীয় প্রকার।

অতঃপর দেখা গেল, ফোঁটার রিক্লেইমিং-এর বিষয়টি হয়ে যাচ্ছে আরও ডায়নামিক। সেখানে লিঙ্গপরিচয় হয়ে যাচ্ছে আরও ফ্লুয়িড। দেখলাম, রূপান্তরিত বা রূপান্তরকামী বোনেরা (যিনি জন্মসূত্রে পুরুষ ছিলেন) ফোঁটা দিচ্ছেন রূপান্তরিত বা রূপান্তরকামী ভাইদের (যিনি জন্মসূত্র ছিলেন নারী)। এমন একটি গণফোঁটা উৎসবের সাক্ষী থাকা গেছিল, যেখানে মেয়েদের আজন্মলালিত ইচ্ছা ছিল ফোঁটা দেওয়ার, অথচ তাদের জোরজার করে ফোঁটা নিতে বাধ্য করা হত পুরুষাবতারে৷ মেয়েলি যা কিছু, তার অধিকার পেলেই তারা পূর্ণতা পায় বলে ভাবে। তাই 'ভাই কেন আমাকে ফোঁটা দেবে না?' প্রশ্ন করার থেকে তারা দূরত্ব রাখে আপাতত। এ হল রিক্লেইমিং-এর তৃতীয় প্রকার।

অন্যদিকে, সনাতনের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ আছে যে প্রথার, তাকে রিক্লেইম করা সম্ভব নয়, বা উচিত নয়, এমনটা বললেন বিপরীত শিবির (শুচিবায়ুগ্রস্ততা তো কারও একচেটিয়া নয়)। আচারের দোহাই দিয়ে প্রচেষ্টাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের হয়তো ভেবে দেখা দরকার, থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস— এই তিন হল হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতার প্রাথমিক কথা৷ ভাববাদী হেগেল বলেছিলেন, দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমেই ভাবনার বিবর্তন হয়। সনাতন ভাইফোঁটাকে যদি থিসিস ধরি, তবে নারীবাদ দিল তার অ্যান্টিথিসিস। আর এই আদানপ্রদান থেকে যে সিন্থেসিস ঘটল, তা কি অধুনা ভগিনীদ্বিতীয়া বা বোনফোঁটা?

রিক্লেইমিং-এর এত রকম স্তরকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেব, সে সাধ্য আমার নেই।  বরং আমার মনে পড়ল বিভাসের কথা। বিভাস যদি 'ক্লোসেট' থেকে বেরোতে পারত, মানে সোচ্চারে ঘোষণা করতে পারত আত্মপরিচয়, তাহলে সেও ট্রান্সপার্সনদের এমন অনুষ্ঠানে আসতে পারত, ভাবি আমি। অথচ, সবাই তা পারে কই? তারপর ভাবি, আচ্ছা, ভাইয়ের বোনকে ফোঁটা দেওয়া আর বোনের ভাইকে ফোঁটা দেওয়া —  দুটোই যদি একই রকম স্বাভাবিক হত সব স্থানে ও কালে, লিঙ্গনির্বিশেষে অগ্রজ-অনুজ-ভ্রাতা-ভগিনী-আত্মীয়-বন্ধুর জন্য শুভকামনাই শুধু যদি মুখ্য হত, ফোঁটার দাতা ও গ্রহীতার ভূমিকা যদি লিঙ্গভেদে দৃঢ় ভাবে নির্দিষ্ট না হয়ে যেত, তা হলেও কি বিভাস পালাত ফি বছর? বোধহয় না৷ 

৪.
নতুন এই জেশ্চারগুলোকে তাই অস্বীকার না করে বরং অভিবাদন জানাই। শুধু নিশ্চিন্ত না হয়ে, প্রশ্ন, আরও প্রশ্ন করি তাদের। প্রশ্নের আগুনেই তো প্রয়াস নিখুঁত হয়। যেমন, প্রশ্ন করি, আলোকিত, সচেতন, শহুরে বৃত্তের বাইরে পা রাখলেই দপ করে নিবে যায় কেন তাদের অস্তিত্ব?

সেখানে ভাইফোঁটায় এখনও উপবাস করে বোন। ভালবাসার চেয়ে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের নিগড় বড় হয়ে ওঠে। আবার এই যে ভাই এল বোনের শ্বশুরবাড়িতে, সেখানে তার সামনে যাতে নিজের দুঃখ, নির্যাতন, অনধিকার প্রকাশ না হয়ে পড়ে, সে নিয়ে বোন থাকে সচেতন। সেই বোন হয়ত গৃহবধূ, সে সঙ্কোচে হাত পাতে বরের কাছে, যাতে ভাইফোঁটার জোগাড় করতে পারে। বর দেন মতিগতি ভাল হলে, মেজাজ বিগড়ে না থাকলে। ভাইয়ের জামাকাপড়, ভাইয়ের জন্য মিষ্টি কিনতে বোন বাজার উথাল-পাথাল করে সামান্য পুঁজি নিয়ে। 

এমন এক বোনকে যেন দেখলুম আজ মিষ্টির দোকানে। কাঁখে ছেলে। একই প্যাকেটে চার রকম চার খানি মিষ্টি নিল সে—  একটি সন্দেশ জাতীয় মিষ্টি আবার ভাইফোঁটা-লেখা বিশেষ ছাঁচে তৈরি। তারপর যে পঞ্চাশ টাকার নোটটি বের করল, সেটি ছেঁড়া। দোকানি জানাল, চলবে না৷ মেয়েটি করুণ মুখে বলল, 'কন্ডাক্টার দিল যে!' কর্মচারী বলল, খানিক যেন মালিকের মনে দয়ার উদ্রেক করতে, 'বাচ্চা সামলাতে গিয়ে দেখেশুনে নিতে পারোনি, নাকি?' হয়ত গৃহস্বামী একশটিই টাকা দিয়েছিলেন যাতায়াত ও ভ্রাতৃসেবা বাবদ। হতে পারে তাঁর ততটুকুই সামর্থ্য। আবার এমনও হতে পারে, তা তাচ্ছিল্যে দেওয়া যৎসামান্য। কর্মচারী শুধোয়, 'আর নেই?' মেয়েটি মাথা নাড়ে। মালিক বলে, 'কি মুশকিল! কিছু খুচরোটুচরোও তো নিয়ে বেরোয় মানুষ, রাস্তা-ঘাটে…' মিষ্টির প্যাকেট ফিরিয়ে দিয়ে মেয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলে, 'দেয়নি।' অথচ দয়ার দান নয়! আর কিছু না হোক, শ্বশুরবাড়িতে গৃহকর্ম করার জন্যও এর বেশিই প্রাপ্য ছিল মেয়েটির।

এই মেয়েদের যাতনার রোজনামচায় কি ভাইয়ের ক্ষণিক আগমন, বা ভাইফোঁটা উপলক্ষে বাপের বাড়িতে আসতে পারার আনন্দ খানিক মলম লাগায়? অথচ আমরা এও জানি যে, প্রায় প্রতিটি পিতৃপরিবারও পিতৃতান্ত্রিক। যে ভাইয়ের উপলক্ষে এই ফোঁটা-আয়োজন, হয়ত তার জন্যই আশৈশব পাওয়া হয়নি মাছের পেটি বা দুধের সর। তুলনাটা গুড আর ইভিলের নয়। তুলনাটা দুই মন্দের। শ্বশুরবাড়ির অনাদরের চেয়ে বাপের বাড়ির অনাদরের তীব্রতা যদি হয় এক কণাও কম হয়, তবে মেয়ে তাকেই বুঝি জ্যোৎস্না-দেখা জানালা ভাবে। 

এ-সব তল্লাটে বোন-ফোঁটা কই?

৫.
ভাইফোঁটা ঘিরে পুরাণে যতরকম গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে যম আর যমুনা/যমীর গল্পটিই অধিক আলোচিত, যমীর অজাচারেচ্ছা সহ। কিন্তু আরেকটি গল্পও প্রচলিত, সেটি কৃষ্ণ সুভদ্রার। কৃষ্ণ নাকি নরকাসুর বধ করে ফেরার সময় সুভদ্রার বাড়িতে হঠাৎ হাজির। আনন্দিত সুভদ্রা ঘটা করে তিলক পরিয়ে দাদাকে অভ্যর্থনা করলেন, যা থেকে শুরু হল ভাইফোঁটা। এই কৃষ্ণ-সুভদ্রার প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিতে পারে, মহাভারত-এ সুভদ্রা হরণের উপাখ্যান। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, স্বয়ম্বরে সুভদ্রা কাকে পছন্দ করেন বলা যায় না, কিন্তু হরণ করে বিবাহ করায় ক্ষত্রিয়র বাধা নেই। সুভদ্রার সম্মতির তোয়াক্কা, স্বাভাবিক ভাবেই, করা হয় না। পুরো 'ডিল'-টিই কন্যার দাদা ও হবু বরের মধ্যে সারা হয়ে যায়।

আধুনিক ভারতেও বিষয়টি কি তেমনই নয়? পিতৃপরিবারে বোনের পোশাক-আশাক, রাত করে বাড়ি ফেরা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদির পাহারাদার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যতটা বাপ-কাকা, ততটাই দাদা। সেদিন এক বছর বারোর ছেলের ভিডিও দেখলাম। সে আরএসএস-এর সভায় এসেছে। বলছে, 'হামারে বহেনোকো মুসলমানোসে বচানা হ্যায়। উওলোগ হামারে বহেনোকো প্যায়ারকে লালজ দেকে ভাগা লে যাতে হ্যায়।' তার স্বরও পুরুষালি হয়নি এখনও, অথচ দাদাগিরির পাঠ সে পাচ্ছে যথাবিহিত। অনার-কিলিং-এর কারিগরদেরও অনেকেই মেয়েটির দাদা বা ভাই। বোন-ফোঁটার বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোয় সে সব উপত্যকায় কোনো বাড়া-কমা হয় না।

৬.
এদিকে আমাদের চয়নিকাদি মন খারাপ করে বসে থাকে প্রতি বছর ভাইফোঁটা এলে। চয়নিকাদি সহকর্মী একজন। কোনো নারীবাদী আদর্শের কারণে নয়, ভাইফোঁটায় যায় না সে, দাদাও আসে না—  কারণ দুই পরিবারে বনিবনা নেই।

চয়নিকাদি তেমন কিছু করেনি৷ মায়ের পর বাবাও গত হলেন যখন, তখন দাদা বলেছিল, বাবা যেহেতু উইল করে যাওয়ার সময় পাননি, আর বাড়িতে বা জমি-জমায় যেহেতু বোনেরও অধিকার, তাই বোন নিঃশর্তে দাদাকেই লিখে দিক সব। দাদা আরও বলেছিল, 'এ তো জানা কথাই যে উইল করতে পারলে বাবা আমাকেই সব দিত!' বৌদি বলল, 'এমন তো সবাই করে। আমিও করেছি। দাদা বা ভাই থাকলে, সম্পত্তি লিখে দিতে হয়। আমরা মেয়েরা তো বিয়েতে যথেষ্ট নিয়েছি।'

চয়নিকাদি খোঁচাটা হজম করে বলেছিল, 'একটা-দুটো ঘর অন্তত আমার থাকুক।' দাদা আকাশ থেকে পড়েছিল। এমন আইনিসম্মত, ন্যায্য 'আবদার' তো কেউ করে না সচরাচর! 'ভালো মেয়ে' হওয়ার লোভে এত বেশি মেয়েরা সম্পত্তি লিখে দেয় সহোদরকে যে, সে এক অলিখিত সমান্তরাল নিয়মে পরিণত হয়েছে। অন্যরকম যা কিছু, সবই অতএব বেহায়াপনা। এমনকী এ নিয়ে আলোচনাও স্পর্শকাতর। 

ভারতের দেওয়ানি আইনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধারা অনুসারে মেয়েদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার স্বীকৃত। (হিন্দু আইন, খ্রিস্টান আইন অনুসারে সমান সম্পত্তির অধিকারী হলেও মুসলিম আইন অনুসারে মেয়েরা ভাইয়ের অর্ধেক সম্পদের হকদার)। অথচ এই সম্পত্তি দাদা বা ভাইকে 'স্বেচ্ছায়' দিয়ে দেওয়াই এখনও ভ্রাতৃপ্রেমের মাপকাঠি। মেয়েদের সম্পদের উত্তরাধিকার আইন ঠিক মতো প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, তা সঠিক ভাবে বলার জন্য কোনো বিস্তারিত সমীক্ষা হয়নি। নানা ইতস্তত সমীক্ষার ফল তাই একে অপরের থেকে একটু-আধটু পৃথক হয়৷ তাও প্রাথমিক তথ্য থেকে মনে হয়, অন্তত ভূসম্পদের মালিকানা ২০ থেকে ৩০ শতাংশর বেশি নয় মেয়েদের। আরও একটি আকর্ষক তথ্য জানা যায় এই পরিসংখ্যান থেকে। গ্রামাঞ্চলের থেকে শহরে মেয়েদের স্থাবর সম্পদের পরিমাণ আরও কম। অথচ শহুরে অঞ্চলেই না ইদানীং বোনফোঁটার প্রচলন? 

এইখানে এসে সন্দিগ্ধ মন প্রশ্নবহুল হয়ে পড়ে। এই যে গদগদ সখ্য ভাইবোনে, শহরে সীমাবদ্ধ হলেও এই যে ভাইয়েদের বোনফোঁটার আয়োজন, সম্পত্তি বিভাজনের প্রসঙ্গ এলে, সে আয়োজন, সে সংহতি থাকবে তো? আচার পাল্টালেই তাই দায় শেষ হয় না, পাল্টা  তে হয় সার্বিকভাবে যাপনও। 

অধিকার না দেওয়ার পিছনে অবশ্য দায়িত্ব-এড়ানোর যুক্তিও দেওয়া হয়। পিতৃমাতৃদায় তো পুত্রেরই সমাজমতে। বাবা-মা থোড়াই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কাটাবেন শেষ জীবন? পণের অজুহাতও আছে। আমূল পরিবর্তন তাই সবখানে প্রয়োজন। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দায়িত্ব ছেলে-মেয়ে উভয়েরই হোক। বিয়ের উপঢৌকন যতটা বর্জনীয়, ঠিক ততটাই প্রয়োজনীয় মেয়ের 'ঘরে ফেরা'-র আশ্রয়টুকু। এই 'ঘরে-ফেরার' ঠিকানা সম্পর্কে আশ্বস্ত হলেই যে কত মেয়ের উপরে ঘটা গৃহহিংসা ঠেকানো যেত! তাই নিশ্চিত হোক তার সম্পত্তির অধিকার। সামগ্রিক ভাবে এত বদল আসতে ঢের দেরি। কিন্তু যদি বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনো পরিসরে তা আসে, এসে থেকে, তবে সেখানে, এবং একমাত্র সেখানেই শোভা পায় ভাইয়ের বোনকে ফোঁটা দেওয়ার নতুন প্রয়াস। 

৭.
পিতৃতন্ত্র এতটাই ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়া এক কাঠামোগত ব্যাধি, দু-একটা ক্যালপল খাওয়ার সিম্পটম্যাটিক ট্রিটমেন্টে যার প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। ভাইফোঁটা কোনো অসুখ নয়, অসুখের নামটি পেট্রিয়ার্কি। ভাইফোঁটা তার একটি লঘু, বলা যায় অপেক্ষাকৃত 'বিনাইন' প্রকাশ মাত্র। ভাইফোঁটাকে রাতারাতি বোনফোঁটায় বদলে দিয়ে যেমন রোগের নিরাময় হবে না, তেমনই শ্লেষ দেগে লোকাচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেও হবে না রোগের চিকিৎসা। চিকিৎসার জন্য চাই ধৈর্য আর সময়। সম্পত্তি লিখে দেওয়া মেয়েটির পাশে, ছেঁড়া নোট হাতে মিষ্টি কিনতে আসা মেয়েগুলির পাশে, মেয়ে হয়ে ভাইফোঁটা দিতে চাওয়া আপাত ছেলেটির পাশে বসা দরকার দুদণ্ড। ব্যঙ্গ নয়, নিদান নয়, অনেক কথোপকথন দরকার৷ কে কী চায়, আর তারা আর কী কী চাওয়ার অধিকার রাখে, তা নিয়ে আদানপ্রদান চাই অবিরত। ভাইফোঁটাই হোক, বা বোনফোঁটা— তা আচার মাত্র। আর আচার সমাজমানসের প্রতিচ্ছবি। সাম্যের পৃথিবীতে, নিদেন সাম্যের দেশে, নিদেন সাম্যের লোকালয়ে, কিংবা অন্তত সাম্যের একান্ত একচিলতে উঠোনে সবাই সবার কপালে স্নেহের ফোঁটা পরিয়ে দিক না! সে প্রয়াসকে স্বাগত। কিন্তু সাম্যটা বুঝে নেওয়া চাই, যাতে বাকিটা বাইরের মেকি আভরণ না হয়ে যায়।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More