বিঘের পর বিঘে ধান পচে রয়েছে। পুকুরগুলোর জলের রং কোথাও কালো, কোথাও নীল। মরে গেছে সমস্ত মাছ। পাটক্ষেতে বড়ো হয়ে যাওয়া সমস্ত পাট দুমড়ে পড়ে আছে। সমস্ত এলাকা জুড়ে এক বীভৎস তাণ্ডবের চিহ্ন। চারিদিকে গাছ পড়ে রাস্তা ভেঙে গেছে। কোথাও নদীর জল উঠে এসে রাস্তা ভেঙে ঢুকে গেছে বসতি এলাকায়। এরকমই অজস্র দৃশ্য ছড়িয়ে আছে উত্তর ২৪ পরগনার টাকি থেকে ৮ কিলোমিটার ভিতরে, ইছামতীর পাড়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমানা অঞ্চলের জালালপুর গ্রামে। গত ২০ মে–র ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে এই অঞ্চল। অথচ প্রশাসনিক ভাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিপর্যয় নিয়ে কিছু চেষ্টা হলেও, উত্তর ২৪ পরগনা সম্পর্কে নিশ্চুপ প্রায় সকলেই।
চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা মাটির ঢিবি। যিনি এনে হাজির করলেন ওই ঢিবির সামনে, তাঁর নাম আন্না মণ্ডল। জিজ্ঞাসা করা হল – ‘কোথায় আপনার ঘর, কতটা ভেঙেছে? উত্তর এল – ‘ঘরের উপরই দাঁড়িয়ে আছেন। পুরো ঘরবাড়ি চাপা পড়ে গেছে। সাইকেল, ফ্যান সব এই মাটির ঢিবির তলায়। ঝড়ের আগে যদি ইস্কুলে গিয়ে না উঠতাম, সবশুদ্ধ চাপা পড়ে যেতাম।’
আরেক বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল শুধু ঘরের কাঠামোটা রয়েছে, চাল নেই, দেওয়াল নেই। মেঝেতে তলতলে পাঁক, অন্যদিকে এক হাঁটু জল। নদীর জল উঠে এসেছিল প্রায় ১৮ ফুট উপরে। এরকম অজস্র দৃশ্য দেখা গেল জালালপুরের মণ্ডল পাড়া,দাস পাড়া ও দফাদার পাড়ায়। অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন এলাকার স্কুলবাড়িতে। ভিজে নষ্ট পড়ার বই, খাতা, রং-পেনসিল রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে, যেন একটুকরো বইপাড়ার দৃশ্য।
লোকাল বোর্ডের মেয়াদ শেষ। অতএব কোনো বোর্ড মেম্বার আসেননি এ-অঞ্চলে। এমনকি কোনো সংগঠন বা এনজিও-র দেখা পাননি এলাকার মানুষ। ক্ষোভে কেউ কেউ বলেন, ‘ওপারে হাসনাবাদ পেরিয়ে এত ত্রাণ যাচ্ছে, আমাদের কেউ দেখে না। মানুষ নই কি আমরা?’
এলাকার বাসিন্দা অনুপ কুমার ঘোষ ও আফসার আলি যোগাযোগ করেন বর্তমানে কলকাতায় গবেষণারত এলাকার ভূমিকন্যা স্মিতা হালদারের সঙ্গে। যদি কিছু করা যায় এলাকার মানুষের জন্য। স্মিতা চেষ্টা শুরু করেন। সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন টাকির চন্দ্রাণী সাহা। স্মিতা ও চন্দ্রাণী যোগাযোগ করেন বিভিন্ন মহলে। যোগ দেন পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দীপায়ন ধরও। যোগ দেন অমিত দে। তৈরি হয় ‘সংহতি’। এমন এক সংগঠন, যার উদ্দেশ্য এই গৃহহীন মানুষদের ঘর ফিরিয়ে দেওয়া।
ফান্ডিং করে এখনও অবধি ‘সংহতি’ সাতটি পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে নতুন করে ঘর তৈরির জন্য বাঁশ ও ত্রিপল। এরপর আরও ১১টি পরিবারের হাতে বাঁশ ও ত্রিপল তুলে দেবে তারা। ছাদ ছাওয়ার জন্য এই ষোলোটি পরিবারের জন্য কেনা হচ্ছে টালি। প্রথম পর্যায়ে দাসপাড়া, মণ্ডল পাড়া ও দফাদার পাড়ার এই ষোলোটি পরিবারের পর, দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি দুঃস্থ মানুষগুলির জন্য আরও চেষ্টা করবেন বলে জানান স্মিতা। তাঁরা নিয়মিত কলকাতা থেকে ঐ এলাকায় যাতায়াত করছেন, জানালেন দীপায়ন। আর এলাকায় থেকে সমস্ত কাজ সামলাচ্ছেন চন্দ্রাণী।
দুর্গত মানুষগুলি হারিয়েছেন অনেক, তবু এই সময়ে সংহতির এই পদক্ষেপে আশার আলো দেখছেন তাঁরা। নিজের একটা ঘর হবে আবার। আবার স্বাভাবিকতায় ফিরবে জনজীবন। এই আকালেও তাঁরা যদি স্বপ্ন দেখেন, কার তাতে কী?
Powered by Froala Editor