বইয়ের পাশাপাশি, প্রকাশকদের এবার ই-বুক নিয়ে ভাবারও সময় এসেছে

 একটা সময় ছিল, যখন পুঁথি লেখা হত হাতে।
তারপর ছাপানোর ব্যাপার এল।
বই থেকে এল কিন্ডলে।
এটা একটা ব্যাপার গেল।
আরেক দিক বলি।
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক 
এই দুটি শব্দকে বোল্ড করে দিলাম।
এই দুটি শব্দ কী কী করেছে দেখা যাক।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে বড় বড় কাগজ ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। প্রিন্ট ভার্সন ব্যাপারটাই উঠে যাচ্ছে। আমাদের রাজ্যেই বেশ কিছু বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে বা প্রবল ক্ষতির মুখে পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলছে। ছ ইঞ্চির ফোনে সব চলে আসছে।
একটা সময় খবর পুরনো হলে বলা হত ওটা তো ঠোঙা হয়ে গেছে।
এখন পরের দিন যে খবরের কাগজটা আসছে, সেটা ঠোঙা হয়েই আসছে। লাদাখে চিন কী করল, সেটা যখন ঘটছে তার দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা ফোনে পেয়ে যাচ্ছি। পরের দিন খবরের কাগজ দেখে আমাদের নতুন করে আর বিস্মিত হতে হচ্ছে না।
আবার আরেকটা শব্দকে বোল্ড করার প্রয়োজন পড়ছে।
লকডাউন 
প্রিয় পাঠক, আসুন, আমাদের জীবনকে লকডাউনের আগে এবং পরে, এই দুটি ভাগে ভাগ করা যাক। করোনা আসার পরে আমাদের যাপনটাকেই পাল্টে দিয়েছে। এটা ছোঁয়া যাবে না, ওটা ছোঁয়া যাবে না। তাকে ছোঁয়া যাবে না, বার বার হাত ধুয়ে যেতে হবে এবং সবার উপরে, আমাদের ঘরে থাকতে হবে।
সীমাহীন নৈঃশব্দ্য তৈরি হয়ে গেল আমাদের প্রাণকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিটে। কী ভয়াবহ নৈঃশব্দ্য! যে বই বাঙালির হৃদয় জুড়ে আছে, সে বই এবং তার বেচাকেনার ভরকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিট বন্ধ হয়ে গেল।
ভাবা যায় না।
তারপরে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এল আমফান। জলে থইথই বইপাড়া, মাথায় হাত বই ব্যবসায়ীদের। এ যে কত বড়ো ক্ষতি করে দিল, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
লকডাউনের আগে অবধি কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব বেশি ক্যাচাল লাগেনি। প্রিন্ট মিডিয়া তার মতো ছিল, লোকজন একটা পত্রিকায় লেখা ছাপলে নাক উঁচু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিচ্ছিলেন, সমান্তরালভাবে ফেসবুকের দুনিয়া তার মতো করে একটা সাহিত্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে নিয়েছিল, যেটা নাকি আবার প্রিন্ট মিডিয়ার লোকজন বরাবর ভীষণভাবে হতচ্ছেদ্দা করে এসেছে। “ওহ, ও ফেসবুক কবি, ওসব কত দেখেছি, ওর পাঠকরা কিস্যু বোঝে না, জানেন না তো।” এই অবধিই ছিল।
লকডাউন এসে কী হল, এই সব কিছুকে ধরে একটা বেশ জোরে একটা নাড়া দিয়ে দিল। বইয়ের দোকান বন্ধ, প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ, এদিকে মানুষ বাড়িতে বসে আছে, তাদের সময় কাটছে না, অফিস করেও সারাদিন গাদাগুচ্ছের সময়, কাহাতক আর ভীম ছুটকির বিয়ে আর ক্যারিমিনাটি টিকটক নিয়ে ঝামেলা পোষায়? মস্তিস্কও তো খোরাক চায়।
ঠিক এই জায়গাটায় আমার মনে হয়েছিল, এখন যদি পিডিএফ বিক্রি করে মানুষের ত্রাণের জন্য কিছু টাকা তুলে দেওয়া যায়, তাহলে কেমন হয়?
সে সময়টা করোনার জন্য লকডাউন চলছে। আমি ঠিক করলাম আমার একটা অসম্পূর্ণ উপন্যাস, ‘যখন এসেছিলে’কে শেষ করে পিডিএফ হিসেবে বিক্রি করব।
হ্যাঁ, সরাসরি পিডিএফ। অন্যান্য সময় হলে বই করতাম, কিন্তু আমি ঠিক করলাম পিডিএফই বিক্রি করব।
বলেছিলাম আড়াইশো কপি প্রিবুক হলে তবেই সে পিডিএফ দিনের আলো দেখবে, না হলে নয়। ‘যখন এসেছিলে’ পিডিএফটি দুশো টাকা দাম করেছিলাম। তিনশোর বেশি প্রি বুক হয়েছিল তখনই।
নড়েচড়ে বসলাম। এভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করা যায় ভাবতে পারিনি। টাকাটা ভারত সেবাশ্রম, রামকৃষ্ণ মিশন এবং রাজ্য সরকারের রিলিফ ফান্ডে দিলাম। এরপর আরেকটা উপন্যাস আনলাম ‘নীল কাগজের ফুল’। ‘নীল কাগজের ফুলে’র পিডিএফ এখনও বিক্রি হয়ে চলেছে এবং তা এক হাজারের বেশি লিগাল পিডিএফ বিক্রি হয়েছে। এই উপন্যাসটা গুগল বুকসেও নিয়ে এসেছি।
এরপর আমফান এল।
আমি নিজের বই নিজেই পাবলিশ করি। ছ’টা বই বাদ দিয়ে বাকি সব বইই সেলফ পাবলিশড। নিজেই প্রেস থেকে বই ছাপিয়ে নিজের প্রোফাইলে বিজ্ঞাপন দিই। যা অর্ডার আসে, সেটা পাঠিয়ে দিই।
ফেসবুক লেখক, বোঝেনই তো, চার পাঁচশো কপি একটা বইয়ের বিক্রি হত। নিজেই পাঠিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। অসুবিধা হচ্ছিল।
ঠিক করলাম ত্রাণের জন্য সব বই পিডিএফে নিয়ে আসব। কিনুক মানুষ।
মানুষ এগিয়ে এলেন।
এখন অবধি আমার বইয়ের পিডিএফ বিক্রি করে আমি রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠনে মোট ছ’লাখ ষাট হাজার টাকা তুলে দিতে পেরেছি। এছাড়াও দুটো গল্প কুড়ি টাকা, দুটো গল্প তিরিশ টাকা, এভাবে ছোটো ছোটো পিডিএফও বিক্রি করছি ত্রাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।
লক্ষ্য দশ লাখ টাকা।
লিখে এবং পিডিএফ বিক্রি করে।
এবার আমার কথা বাদ দিয়ে আসি ডিজিটাল মিডিয়ায় আমাদের বই আনার কথায়।
ডিজিটাল মিডিয়াই যদি ভবিষ্যত হয়, তাহলে কিন্তু কিছু চিন্তার ব্যাপার থেকেই যাচ্ছে। প্রেস জিনিসটাই তো বাদ চলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে একটা ইমারতের ভিতটাই নড়ে যাবে।
একটা বই লেখেন লেখক। সেটা শুধু লেখকের বই হয় না। তাতে পরিশ্রম থাকে ডিটিপি শিল্পী থেকে শুরু করে বাঁধাই শিল্পী সবার। যদি ডিজিটাল হয়ে যায় সব তাহলে তারা কী খাবেন? কী করবেন?
স্বস্তির ব্যাপার অবশ্য আছে। সেটা হল বইয়ের পাঠক থাকবেন। তারা কোথাও যাবেন না। বই বইয়ের জায়গাতেই থাকবে।
আসি পিডিএফের কথায়।
কিন্ডলে বাদ দিয়ে এখন বাজার ছেয়ে যাচ্ছে বেআইনি পিডিএফে। ঠিক যেভাবে টরেন্টে সিনেমা আসে।
নিশ্চয়ই মনে আছে এইচ বি ও র গেম অফ থ্রোন্সের এপিসোডগুলো লিক হয়ে যেত কীভাবে? এতে দর্শক হয়ত লাভবান হন, কিন্তু একটা মারাত্মক সমস্যা থেকে যায়।
সেটা হল যাদের পরিশ্রমের দাম পাওয়ার কথা, তারা সেটা পান না।
পাঠকদের এখানে খানিকটা দায়িত্বের জায়গা আছে বৈকি।
উভয় সংকটের ব্যাপার হল, এই চরম উন্নত টেকনোলজির বাজারে আপনি ইল্লিগাল পিডিএফ তৈরি করাও আটকাতে পারবেন না।
সেক্ষেত্রে হে প্রকাশক, আপনার এবার নিজেদের দিকে তাকানোর সময় এসেছে। লিগাল ই বুক তৈরি করার জায়গায় আসতেই হবে ভবিষ্যতের প্রকাশকদের।
বই তো থাকবেই, কিন্তু ই বুকের ক্ষেত্রেও বাঙালি প্রকাশকদের ভাবতেই হবে।
এবং…
পাঠককে বিশ্বাস করতে হবে।
নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি, পিডিএফ পড়ে বহু পাঠক বই কিনেছেন। বইটা নিজের সংগ্রহে রাখতে চেয়েছেন। পিডিএফ ভালোমন্দের বিচার করতে শিখিয়ে দেয় পাঠককে। জালি জিনিস কিনছেন কিনা, সেটা বুঝতে শিখিয়ে দেয়।
একটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করি, মনে আছে একটা সময় নোকিয়ার রমরমার কথা? সময়ের সঙ্গে নিজেকে পাল্টাতে না পেরে নোকিয়া এখন শুধু আরেকটা ব্র্যান্ড হয়েই রয়ে গেল। ভাবা যায়?
 ভবিষ্যতের দিন, সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টের দিন। 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Powered by Froala Editor

More From Author See More