হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একশোয় পড়লেন। আমার প্রথম গলার প্রেমে পড়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। সেই যে পড়লাম, এখনও উঠতে পারিনি। আমি একফোঁটা বাড়িয়ে বলছি না, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। গাম্ভীর্য যে এত মধুর হতে পারে – এ চিজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা না শুনলে বুঝতে পারতাম না। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, হেমন্তের চারের দশকের শেষদিক থেকে সাতের দশকের শুরু অবধি যে গলা ছিল- এ গলার জন্যে হন্যে হওয়া যায়! বলার কথা এই, হেমন্তর গান শুনে আমি কোনোদিন কাঁদিনি। হেমন্তের গলা শুনলে কান্না চাপার রসদ পাই। কাঁদান তো ছয়ের দশকের রফি। বেড়াল যেমন মাছের জন্যে ছুঁক ছুঁক করত, আমি হেমন্তের গানের জন্য করতাম।
বৃষ্টিতে টালির বেয়ে রাখা জল ধরে রাখার জন্যে গামলা ডেকচি বসানো থাকত, কখনো পিসির কোলে পাশের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে শুনেছি, পাহাড়ের এত পথ এত বাঁধা পেরিয়ে নদী কোথাও কি চলত!
একটা লোক বলছেন, আমি গাড়ি কিনেছি চারটে বেশি টিউশান করব ব’লে, শখে না। কলকাতার বাসে ট্রামে যাতায়াত করলে পা ভেঙে বসে থাকব। এই কমিটমেন্ট হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে হেমন্ত বানিয়েছে বলে মনে হয়।
আমাদের দেশে পুজো করার একটা চল আছে, আসলে প্রফেট আর প্রফিট হাতধরাধরি করে চলে কিনা! এবারে মুস্কিল হচ্ছে কেন পুজো করছি জানি না। এ যদি আকাশ হয়, তোমায় কি বলে আমি ডাকব বল - তালাত গাইলেন, সঙ্গের গলাটা রাখি বিশ্বাস, পরে যিনি গুলজার হলেন। মুকুল দত্তের লেখা এ গানটার এত মিষ্টি সুর করলেন হেমন্ত, আমার মনে হয় ভদ্রলোক জানতেন, ওঁর গলার গাম্ভীর্যে এটা মানাবে না। তালাত মেহমুদকে দিয়ে গাওয়ালেন!
আরও পড়ুন
অসিতবরণের সূত্রেই যোগাযোগ আকাশবাণীতে, সেই প্রথম বেতারে গাইলেন হেমন্ত
একজন মিউজিক ডিরেক্টার গানটা যখন করেন দেখতে পান কাকে দিয়ে গাওয়াবেন! অনেক ক্ষেত্রে হয় শিল্পী ভেবেই গান তৈরি হয়। বলার কথা হচ্ছে, এখানে যাই হোক না কেন, কোন শিল্পীর গলায় শুনে মনে হয় না এঁর গলায় এটা বেমানান। এখানেই একজন সঙ্গীত পরিচালকের চোখ, চোখ মানে মনের চোখ। সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা অসামান্য বিষয়। ‘মন নিয়ে’ সিনেমায় যখন গাওয়ালেন আশা আর লতাকে দিয়ে। চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়, ঠিক দিলেন লতা মঙ্গেশকরকে। আশাকে দিলেন দীপ জ্বেলে ঐ তারা। আমাদের কাছে দুটো গানই অসামান্য আর কঠিন। কিন্তু শুনলে বোঝা যায়, আশাকে যে গানটা দিলেন, সেটা তুলনামূলক বেশি কঠিন। কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ালেন, এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়... কী রোম্যান্টিক সুর। সুর তৈরি করার ক্ষেত্রে হেমন্ত সহজ আর সাবলীল। সরল কথাটা ইচ্ছে করেই বললাম না। হেমন্ত নিজে বিশেষ কারিকুরি চাইতেন না সুরে। বারবার শ্যামল মিত্রকে বলেছেন, সোজা সুর দিতে ওঁর জন্য। শোনা যায়, নচিকেতা ঘোষ মালতী ভ্রমরে গাইতে হেমন্তকে ডাকলে, হেমন্ত নাকচ করে দেন, পারবেন না এই ভয়ে। বলেন, ‘মানবকে খবর দিন।’ নচিকেতা ঘোষ জহুরি - জোর করে গাওয়ালেন—কী গাইলেন হেমন্ত! বিশেষত সঞ্চারীটা। কিশোরকুমারের জন্য ‘কেন যে তুই চড়লি ওরে বাবুদের জুরি গাড়িতে’—সুরটা করতে চাননি হেমন্ত। রেকর্ড কোম্পানির জোরাজুরিতে করতে হল। বাকি তিনটে গান, তোমায় পড়েছে মনে আবার শ্রাবণ দিনে, আমার পুজার ফুল, সে যেন আমার পাশে আজো বসে আছে। এই তিনটে সুরের চরিত্র একই প্রায়। সিনেমা ছাড়া খুব বেশি হালকা সুরের কাজ হেমন্ত করতেন না তেমন। উনি নিজেই বলছেন, আমার স্টাইল বলতে আমি খুব সহজ সরল একটা ঢং–এর কথা ভাবতে পারি। ইন্দ্রধনু বলে একটা সিনেমা ছিল, অসিতবরণ আর অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়ের। জীবনে দেখিনি যে টিভিতে দিয়েছে সিনেমাটা। সেখানে এমন একটা গান গাইলেন হেমন্ত — কোন ছোট থেকে শুনে আসছি, যদি কোনদিন ঝরা বকুলের গন্ধে। গানের কথা কি বুঝছি, সুরও কি ছাই বুঝি—কিন্তু যেভাবে গাওয়া গানটা, তুলনা হয় না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে একটা আলগোছে ব্যাপার ছিল। আদ্যন্ত প্রফেশনাল, তার মধ্যেও ধুতি শার্ট আর সিগারেটটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মনে মনেও ক্যারি করেছিলেন আজীবন। পাঁচের দশক ছয়ের দশকের বাঙালির মধ্যে একটা আলগোছে বিষয় ছিল, সেটা হেমন্ত নিজের করা সুরে বয়ে নিয়ে গেছেন। হেমন্ত বলছেন, আমার যা স্টাইল, সেটা কাউকে শেখানো মুস্কিল, সাহিত্য পড়ার কথা বলতেন। তার মানে কি এই হেমন্ত কঠিন গান গাননি--- গাঁয়ের বঁধু কি সহজ গান! রানার! চাঁদ কহে চামেলি গো - হিমাংশু দত্তের এ গান তো ওঁর গলায় প্রথমে শুনে বড় হলাম। উমা বসুর গলায় কত পরে শুনেছি। এই গানটার মধ্যে সঞ্চারীটায়, তোমার সুরভি মাখা কুঞ্জ ছায়ে পান্থ আমি যে এসেছিনু ভুলে যেও যে রাগিণী ভাসানু বায়ে, ভুলে যেও ভালো বেসেছিনু... তোমার শব্দটা যে সফিস্টিকেসি দিয়ে উচ্চারণ করলেন। এই সফিস্টিকেসি হচ্ছে চিড়িয়াখানার জহর গাঙ্গুলির মতো।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হল, রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার মূলে তো প্রথমে যদি পঙ্কজ মল্লিক থাকেন, দ্বিতীয় নামটা অবধারিত হেমন্ত মুখার্জির। খেটে খাওয়া মুদির দোকান চালানো নিম্নমধ্যবিত্তের ঘরে, গরিব স্কুলমাস্টারের ঘরে রবীন্দ্রনাথের গান কী বিরাট সব রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের কল্যাণে গেছে! গেছে হেমন্তের দৌলতে। রবীন্দ্রনাথের গান এলিটের গান ছিল। সেখানে উচ্চারণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উচ্চারণ - আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে... বেঁকে–র চন্দ্রবিন্দু, দুবার বেঁকে গাইলেন, ইন্ট্যাক্ট থাকল। সঞ্চারী গাইছেন, শ্রান্তি লাগে পায়ে পায়ে... শ্রান্তি শব্দটা, নিখুঁত। নিখুঁত, কিন্তু কান ধরে শেখানো না, এই এভাবে গাইতে হয়—এরম নয় বিষয়টা। যেমন আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো- ঢ় –এর উচ্চারণ, এত নিখুঁত। কিন্তু কোথাও জোর করে দেওয়া নয়, স্বতঃসিদ্ধ। আর এটা কিন্তু এই চর্চিত সফিস্টিকেসিরই ফসল। রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে কী দেখি পাই না ভেবে গো—একটা জায়গায় গাইছেন, অপরূপ চন্দ্রকলা, না তোমার চন্দ্রহারের গড়ন। দুটো পর ‘র’ এর পর এক সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যে ‘ড়’ গাইতে হল, কতটা স্কিল থাকলে এটা করা যায়!
আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
দেবব্রত বিশ্বাস একটা কথা বলেছিলেন, হেমন্ত যদি চিনা ভাষার খবরের কাগজ সুর করে গান, তাও লোকে শুনবে। সত্যিই তাই- এই রাত তোমার আমার- এই চাঁদ তোমার আমার, কথার কি খুব গুরত্ব আছে, শুনি কিন্তু ঐ সুর আর ঐ গায়কীর জন্য। এই যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান, আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে–তে অশথের ছায়ে মাঠের প্রান্তে দূরে। দূরে কথাটা এমন বললেন ক্যানভাসটাই বড় হয়ে গেল। তেমন তেমন গায়ক, শব্দকে ধরে চোখের সামনে ইমেজ আনতে পারতেন। কিশোর যখন গান, ওহ শাম কুছ অজিব থি। শাম শব্দটা দেখা যায়। কিম্বা রফি যখন গান, ইয়ে শাম ঢল তো লে জরা... শাম দেখা যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন গান, স্খলিত শিথীল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর... হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কামনার ভার বইতে হয়নি তেমন জীবনে। ভদ্রলোক বলছেন, আমার তেমন কোনো উচ্চাশা ছিল না। নাম হয়েছে ভালো লাগে, ব্যস। হেমন্তের জীবন থেকে পাঁচের দশকেই গানের মধ্যেই ‘ঝুরঝুর ঝরে গেছে কামনার ফুল।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিয়ে তেমন কোনো ব্যক্তিগত আক্ষেপ নেই, একটা ছাড়া। হেমন্তের সঙ্গে সুধীন দাশগুপ্তের আরও গান আমরা কেন যে পেলাম না!
Powered by Froala Editor