ফ্রান্সের নানা জেলখানায় বন্দি অসংখ্য অপরাধী। সব দেশেই যেমন থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ শুরু হল এক অদ্ভুত কাজ। অপরাধীদের ছবি তুলে রাখার বন্দোবস্ত আগেই ছিল। এবার শুরু হল তাদের কানের ছবি তোলা। কিন্তু গোটা মানুষটাকে ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ শুধু কানের ছবি কেন?
আরও পড়ুন
তদারকিতে একদল মহিলা বিজ্ঞানী, ৯০ বছর আগে সমুদ্রের তলদেশে অভিযানের গল্প
এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেকের মাথাতেই। প্রশাসনের উপর মহলের কর্তারাও যে খুব একটা বুঝতে পারছিলেন, এমনটা নয়। কিন্তু এই কাজের নির্দেশ যিনি দিয়েছেন অ্যালফানস বার্টিলন। তাঁর হাতেই যে ইতিমধ্যে ফরেন্সিক গবেষণার ভোল বদলে গিয়েছে। এমনকি আর্থার কোনান ডোয়েল তাঁর 'হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিল' উপন্যাসে লিখছেন, অপরাধীদের শনাক্ত করার ব্যাপারে দ্বিতীয় সফল ব্যক্তি শার্লক হোমস। প্রথম স্থানে অবশ্যই অ্যালফানস বার্টিলন। ফলে এই গবেষণার ভিতর থেকে অদ্ভুত কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার হতে চলেছে, এমন বিশ্বাস বুকে নিয়ে একের পর এক অপরাধীর কানের ছবি তোলা হতে লাগল।
আরও পড়ুন
গুপ্ত সিঁড়ি পৌঁছে দিল সমাধিতে, ‘অভিশাপ’ সত্ত্বেও উদ্ধার তুতেনখামেনের মমি
অ্যালফানস বার্টিলন, জন্ম ১৮৫৩ সালের ২৩ এপ্রিল। বলা যায়, অপরাধী শনাক্ত করার বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। পৃথিবীতে কয়েক বিলিয়ন মানুষের মধ্যে থেকে একজন অপরাধীকে খুঁজে বের করা, সহজ কাজ নয়। আজকাল আমরা জানি, আঙুলের ছাপ দেখে সহজেই কোনো মানুষকে শনাক্ত করে ফেলা যায়। তবে উনিশ শতকের শেষ দিকেও এমন কোনো প্রযুক্তির কথা ভাবতেই পারতেন না গোয়েন্দারা। বার্টিলনের হাতেই জন্ম অ্যান্থ্রপোমেট্রিক পদ্ধতি। যে পদ্ধতির বিকাশের মাধ্যমেই জন্ম নিয়েছে আজকের বায়োমেট্রিক পদ্ধতি। অনেকে আবার একে বার্টিলন সিস্টেম বলেও ডাকতেন।
আরও পড়ুন
৩৪০০ বছর আগেকার রাজ্যের সন্ধান মাটির নিচে, পাওয়া গেল শিলালিপিও
তখন অবশ্য পদ্ধতিটা বেশ জটিল ছিল। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের উচ্চতা, গায়ের রং, চুলের রং, চোখের তারার ছবি সমস্তকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড নিতে হত। তবে এভাবেই যে একের পর এক অপরাধীকে শনাক্ত করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বার্টিলন। শুধু ফ্রান্স নয়, পৃথিবীর সমস্ত দেশেই খুব তাড়াতাড়ি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে বার্টিলন নিজেও ভাবছিলেন, সহজ কোনো পদ্ধতি যদি আবিষ্কার করা যায়। আর তখনই কিছু অপরাধীর ছবি দেখতে দেখতে তাঁর মনে হল, মানুষের কানের মধ্যে বিশেষ একটা কিছু আছে। সেটা ১৮৮০ সাল। শুরু হল অপরাধীদের কানের ছবি নিয়ে গবেষণা।
আরও পড়ুন
উচ্চতা সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটাই ছোটো, একসময় পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত ‘হবিট’রা
হাজার হাজার অপরাধীর কানের ছবি নিয়ে বসে থাকেন বার্টিলন। মাপজোক করেন। বিভিন্ন ধরনের চার্ট বানান। আর ফ্রান্সের পুলিশ বাহিনী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে তাঁর নতুন আবিষ্কারের। আবিষ্কার বলতে তেমন বিরাট কিছু অবশ্য শেষপর্যন্ত করতে পারলেন না তিনি। শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, প্রতিটা মানুষের কানের গঠন আলাদা। কিন্তু কানের গঠন দেখে কাউকে অপরাধী বলে শনাক্ত করা যায় না। ছোটো কান হোক বা বড়ো, পাতলা কান অথবা মোটা; অপরাধী হওয়ার সম্ভবনা প্রতিটা মানুষেরই আছে। তাঁর গবেষণার এই ফলাফল ফ্রান্সের প্রশাসনকে হতাশ করেছিল তো বটেই। তবে মানুষের শনাক্তকরণ বিজ্ঞানে এই আবিষ্কার একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছিল অবশ্যই। এর পরেই তো একে একে জানা যাবে, প্রত্যেকের চোখের তারার ছবি আলাদা, প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ আলাদা।
আরও পড়ুন
দুর্গম অঞ্চলে ভেঙে পড়ল বিমান, মৃত সহযাত্রীদের মাংস খেয়ে ৭৩ দিন কাটালেন জীবিতরা
১৯১৪ সালে মারা গেলেন বার্টিলন। আর বার্টিলন সিস্টেমও বেশিদিন চলেনি। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম। আর অপরাধীর ছেড়ে যাওয়া সংকেতের সঙ্গে তার আঙুলের ছাপ জড়িয়ে থাকবেই। কানের গঠনের কিন্তু তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য আজকাল তো শুধু অপরাধী শনাক্ত করার জন্যই নয়, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বায়োমেট্রিক সিস্টেম। আর এই শনাক্তকরণের কাজে কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আইরিশ স্ক্যানের থেকেও কানের গঠন অনেক নিখুঁত তথ্য দিতে পারবে বলেই মনে করছেন ফরেন্সিক বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের জগতে বিপ্লব তো ঘটিয়েছেনই বার্টিলন। তাঁর অসম্পূর্ণ গবেষণা থেকেও হয়তো উঠে আসতে পারে আরও নানা সূত্র।
Powered by Froala Editor