গাড়িতেই চেম্বার, ঘুরে-ঘুরে বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন এই ডাক্তারবাবু

মাটির রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মারুতি গাড়ি। আর তাকে ঘিরে ভিড় করেছে অসংখ্য মানুষ। এই প্রত্যন্ত গ্রামে কোনো ভ্রাম্যমাণ দোকান বসল নাকি? কাছে গেলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে ব্যাপারটা। গাড়ির মধ্যেই বসে রয়েছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। পরনে সাদা অ্যাপ্রন, মুখে মাস্ক, গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ। হ্যাঁ, একজন চিকিৎসক। আর এই গাড়িই তাঁর ‘চেম্বার’। 

ডঃ সুনীল কুমার হেব্বি (Sunil Kumar Hebbi)। বিনামূল্যে তামিলনাড়ুর (Tamil Nadu) প্রান্তিক মানুষদের কাছে এভাবেই চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছেন বেঙ্গালুর (Bengaluru) মলেশ্বরমের এই চিকিৎসক। বিগত ১১ বছর ধরে চলছে তাঁর এই কর্মযজ্ঞ। 

আর পাঁচজন চিকিৎসকের মতো এমডি পাশ করার পর তামিলনাড়ুর এক নাম করা বেসরকারি হাসপাতালে মোটা মাইনের চাকরি পেয়েছিলেন ডঃ সুনীল কুমার। সেইসঙ্গে আলাদা করে বাড়িতে ডিস্পেনসারিও ছিল। সেখান থেকেও আয় মন্দ হত না। কিন্তু একটি ঘটনাই এক লহমায় বদলে দেয় তাঁর গোটা জীবন। 

২০১০ সাল সেটা। তামিলনাড়ুর হোসুর-চেন্নাই জাতীয় সড়ক দিয়ে সেবার বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। আর পথেই ঘটে যায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। চোখের সামনে গাড়ির ধাক্কায় এক স্থানীয় ব্যক্তিকে ছিটকে যেতে দেখেন তিনি। চিকিৎসক হয়েও তারপর কি আর নিজেকে আটকে রাখা যায়? প্রাথমিক চিকিৎসার পর নিজের গাড়িতে করেই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্থানীয় এক হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা করাতেও যে ভালো মতো অর্থের প্রয়োজন। প্রান্তিক মানুষদের কাছে সেই অর্থ কোথায়? না, ওই ব্যক্তির চিকিৎসায় খামতি হয়নি কোনো। সমস্ত খরচের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ডঃ সুনীল কুমার। সেই সঙ্গে প্রান্তিক ভারতের পরিস্থিতির ছবিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। 

আরও পড়ুন
করোনায় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপ্রেরণা যখন কবিতা

এর পরই শুরু হয় এক অন্য লড়াই। সপ্তাহে একদিন করে নিজের গাড়িতে ওষুধ, সরঞ্জাম, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়েই তিনি বেরিয়ে পড়তেন গ্রামীণ ভারত অভিযানে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতেন সেখানকার মানুষের কাছে। কিন্তু এভাবে তো আর সকলের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ২০১১ সালে শেষমেশ তাই চাকরি থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিলেন তিনি। বদলে এই ‘নেশা’-তেই নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করেন তামিল চিকিৎসক। অবশ্য বাড়ির সদস্যরা মেনে নেননি কেউ-ই। উপার্জনের পথ বন্ধ করে দাতব্য কর্ম কার পরিবারই বা মেনে নেয়? 

আরও পড়ুন
এক সময়ের শিকারীরাই আজ পাখির রক্ষক, নেপথ্যে বেঙ্গালুরুর যুবক

কিন্তু কীভাবে সংসার চলে ডঃ সুনীলের? কীভাবেই বা এই চিকিৎসার খরচ সামলান তিনি? ২০১২ সালে মাতৃ সিরি ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন ডঃ সুনীল কুমার হেব্বি। পরিচিতমহল এবং বিভিন্ন সুহৃদয় ব্যক্তিদের অনুদানেই চলে এই ফাউন্ডেশন। সেখান থেকেই উঠে আসে এই কর্মকাণ্ড চালানোর খরচ। ডঃ সুনীলকে পেট চালানোর মতো সামান্য উপার্জনও জোটায় এই সংস্থাই। 

আরও পড়ুন
‘মিথ্যে মহামারী’ তৈরি করে ৮ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন পোলিশ চিকিৎসক

এখনও পর্যন্ত গোটা ভারতে ৮০০টির বেশি মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজন করেছেন ডঃ সুনীল কুমার হেব্বি। প্রান্তিক অঞ্চলের ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ। ২০১৮ সালে তাঁর এই কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি জানান ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডুও। তাছাড়াও একাধিক পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। কিন্তু কোনো প্রশংসাই যেন যথেষ্ট নয় তাঁর জন্য। পৃথিবীতে এখনও মানবিকতা বেঁচে আছে, তারই যেন জ্বলন্ত উদাহরণ তামিলনাড়ুর এই চিকিৎসক… 

Powered by Froala Editor