বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের আনাগোনা আজকের নয়। প্রায় ১০০ বছর আগে জগদানন্দ রায়ের হাত ধরে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাঙালি পাঠক। তারপর সত্যজিৎ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা হাল আমলের অনীশ দেব; গল্প বলতে বলতে মহাকাশে চলে গিয়েছেন সকলেই। কিন্তু চলচ্চিত্রের পর্দায় সেসব গল্প উঠে আসেনি। সম্প্রতি, ‘দিন রাত্রির গল্প’ পূরণ করল সেই ফাঁকটাই।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মুক্তি পেল পরিচালক প্রসেনজিৎ চৌধুরীর দ্বিতীয় সিনেমা 'দিন রাত্রির গল্প'। ইতিমধ্যে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা পেয়েছে এই সিনেমা। 'ইন্দো-স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকাডেমি'র উদ্যোগে স্পেনেও মুক্তি পেতে চলেছে এই সিনেমা। তাই বহুল আলোচিত এই সিনেমাকে ঘিরে দর্শকদের উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রিয়া সিনেমাতে ছবির প্রিমিয়ারে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক প্রসেনজিৎ চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন অভিনেতা রজতাভ দত্ত, সুপ্রীতি চৌধুরী, রায়তি ভট্টাচার্য ও অন্যান্য কলাকুশলীরা।
'দিন রাত্রির গল্প' মুক্তির হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র পা রাখল মঙ্গলের মাটিতে। বাংলা সিনেমায় এই প্রথম দেখা গেল স্পেস শিপ। কল্পবিজ্ঞানের গল্প নিয়ে সিনেমা এর আগে খুব কমই হয়েছে। ২০০৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল কল্পবিজ্ঞান নির্ভর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পাতালঘর’। তারপর দীর্ঘদিন এই জায়গাটা পরিচালকদের অধরাই থেকে যায়। আবার ২০১৭ থেকে ২০১৯ - তিন বছরে পরপর মুক্তি পায় অনুকূল, প্রবাসিনী এবং প্রফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো। কিন্তু এই তিনটে ছবির কোনোটাই মহাকাশে পাড়ি জমায়নি। তবে বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে কিন্তু মানুষের কল্পনা আকাশ ছুঁয়েছে বহু আগেই।
এমন একটি ‘ঐতিহাসিক’ সিনেমা সম্পর্কে কী ভাবছেন অভিনেতা রজতাভ দত্ত? প্রশ্নের উত্তরে প্রহরকে জানালেন - ‘সম্ভবত স্পেসশিপ দেখানোর জন্য যে পরিমাণ খরচ হত, বাংলা সিনেমায় এতদিন সেই পরিমাণ বাজেট ছিল না। এখন অবশ্য ভিএফএক্স-এর সাহায্যে খুব সহজেই এ-ধরনের কাজ করা যাচ্ছে।’
অন্যদিকে পরিচালক প্রসেনজিৎ চৌধুরী জানালেন এই সিনেমাটি তৈরির পিছনে তাঁর ভাবনার কথা। ‘এক ধারার গল্প দেখতে দেখতে দর্শকরা ক্লান্ত। এখন অবশ্য নতুন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে, তবে কল্পবিজ্ঞানের মতো একটি জনপ্রিয় দিককে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। নতুন একটা কিছু করার ভাবনা থেকেই এই সিনেমা।’
অরুণিমা চ্যাটার্জি দীর্ঘদিন ধরে নাসায় গবেষণারত। বয়স্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে ফোনে। কিন্তু সাতদিন ধরে মেয়ের কোনো খবর না পেয়ে চিন্তিত অরুণিমার বাবা মা। ঠিক এইসময় নাসা থেকে লোক আসে তাদের বাড়ি। জানায়, নাসার একটি গোপন অভিযানের জন্য মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দিয়েছে অরুণিমা। মঙ্গলের বুকে প্রথম অভিযাত্রী সে। কিন্তু সত্যিই কি মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর মতো প্রযুক্তি আছে নাসার কাছে? একটি কল্পকাহিনির কাছে এটা অবশ্য বড়ো প্রশ্ন নয়। তবে পরিচালক কাহিনিকে দেখতে চেয়েছেন অন্যভাবে। তাঁর মতে, ‘কল্পবিজ্ঞান কাহিনির দায়বদ্ধতা থাকে বিজ্ঞানের প্রতি।’ ফলে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সম্পূর্ণ কাহিনিকে বেঁধেছেন পরিচালক। কীভাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর সিনেমাতেই আছে। আসলে এখানে পরিচালক একটি বিশ্বাসকে গেঁথে দিতে চেয়েছেন। যে বিশ্বাসে মৃত মানুষ আকাশের তারা হয়ে যায়। সেই বিশ্বাসকে ধরেই দূরবীনে চোখ রেখে মঙ্গলগ্রহ খোঁজে অরুণিমার বাবা মা।
তবে এই সিনেমা আসলে অরুণিমার মঙ্গল গ্রহ অভিযানের গল্প নয়। এই কাহিনি আসলে একটি মানবিক গল্প। মানুষের অস্তিত্বের গল্প। মৃত্যুর গল্প। ‘মৃত্যুকে প্রতিদিন কাছ থেকে দেখেন পরিচালক। তাই সিনেমায় সেই মৃত্যুকেই খুঁজেছেন।’ - বলছিলেন রজতাভ দত্ত। সত্যিই তো, পেশায় ডাক্তার প্রসেনজিৎ চৌধুরী তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই সিনেমা বানাবেন!
সেই মৃত্যুকে পরিচালক দেখেছেন দুটি বিপরীত মেরু থেকে। একদিকে মৃত্যুর রহস্যকে আড়াল করে আছে বিশ্বাস। সেখানে সূর্যোদয়ের দৃশ্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সেই গল্প দিনের গল্প। আর তার ঠিক বিপরীত দিকে আছে রাতের গল্প। সেখানে বিশ্বাস নেই, আছে শুধু প্রশ্ন। রহস্য। আর সেইসব রহস্যের উত্তর খোঁজার চেষ্টা। এই অংশেই দেখতে পাওয়া যায় রজতাভ দত্তকে। রহস্য অনুসন্ধানী মন বিজ্ঞানের পাশাপাশি আঁকড়ে ধরেছে গুপ্তবিজ্ঞান, ভুডুইজম। সেখানে আলো নেই। শুধু জমাট অন্ধকার।
একদিকে বিজ্ঞানের কল্পনা, অন্যদিকে জমাট রহস্য। এই দুইয়ের টানটান সুতোয় কাহিনিকে বেঁধেছেন পরিচালক প্রসেনজিৎ চৌধুরী। স্বল্প বাজেটে এই স্বাধীন প্রচেষ্টা সমালোচক মহলে ইতিমধ্যে প্রশংসা পেয়েছে। তবে চলচ্চিত্র উৎসবের সিনেমা মানেই তা সাধারণ দর্শকদের অধিকারের বাইরে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। মৃত্যুকে ঘিরে থাকা এক মানবিক টানাপোড়েনই এই সিনেমার মূল আকর্ষণ। তার সঙ্গে মহাকাশে পাড়ি তো রইলই!