শচীন কত্তা নিজে একরকম গল্প বললেও অমিত কুমার শুনিয়েছিলেন আরেক গল্প। একদিন কত্তার ফোন পেয়ে বাবার সঙ্গে ছোট্ট অমিত কত্তার বাড়ি গিয়েই বুঝতে পারেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। সবাই থমথমে মুখ করে বসা। কে নেই সেখানে- শচীন, রাহুল, মান্না দে, পরিচালক শক্তি সামন্ত! এই বাঙালি ব্রিগেডের মধ্যমণি রাজেশ খান্না। 'আরাধনা'র শ্যুটিং চলছে, গোল বেঁধেছে 'রূপ তেরা মস্তানা' গানের সুর নিয়ে। কত্তা যে সুর বেঁধেছেন, সেটা সিচুয়েশন অনুযায়ী কারও পছন্দ হচ্ছে না। কত্তার মুখের উপরে বলার সাহসও কারও নেই, আর কত্তা জেদ ধরেছেন এই সুরই তিনি রাখবেন। শেষে সামলে দিলেন কিশোর কুমারই। তিনি বিরক্ত শচীনদেবকে মনে করালেন তাঁরই সুর দেওয়া একটা বহু পুরনো গান - ‘কালকে যাব শ্বশুরবাড়ি/আহ্লাদে খাই গড়াগড়ি/ দেখব তোরে প্রাণভরে সুন্দরী।’ বললেন সেই সুরটাই করতে।
সুপারডুপার হিট 'আরাধনা' আর তার সব গান। সম্রাট হয়ে গেলেন রাজেশ খান্না। তার পেছনে বাঙালি ব্রিগেড। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করলেন শক্তি সামন্তই। আবার রাজেশের ছবি দিয়েই 'অন্য' এক কিশোর কুমারকে সবাই পেল। কত্তার পরামর্শে গায়কিতে বদল এনে দেখিয়ে দিলেন রোমান্টিক গানে তিনিও কম যান না।
তারপর একদিন মর্নিং ওয়াকে গেছেন কত্তা। হঠাৎ কানে এল কারা যেন তাঁকে দেখিয়ে বলছে, ওই দ্যাখ, আর ডি বর্মনের বাবা। ছেলের পরিচয়ে বাবাকে চিনছে! বাড়ি ফিরে স্ত্রী মীরার উপর হম্বিতম্বি করলেন কত্তা, ‘’কত বড় লায়েক হইসে পোলায়! কী এমন সুর করতাসে, অ্যাঁ?’ মীরাদেবী কিছু না বলে ছেলের নতুন রেকর্ড বাবার হাতে তুলে দিলেন।
সিনেমার নাম ‘অমরপ্রেম’। ‘চিঙ্গারি কই ভরকে’, ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’, ‘ইয়ে কেয়া হুয়া’…। শুনতে শুনতে পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ পিতার সব অভিমান গলে গেল! ছবির নায়ক? রাজেশ খান্না! আর নায়িকা? শর্মিলা ঠাকুর।
বাংলা ছবিতে রাজেশ খান্না কাজ করেননি, কিন্তু বাংলার সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল গভীর। ইতিহাসবিদ এস এম এম আহুজার কথায় – ‘তিনি নিজে কোনো বাংলা ছবিতে কাজ না করলেও, প্রচুর বাঙালি চিত্র পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন। যার প্রায় সবই সফল।’
হৃষীকেশ মুখার্জির ছবি আনন্দ ছিল তাঁর জীবনের সফলতম ছবি। এই ছবিতে অমিতাভ বচ্চনকে বাঙালি ডাক্তার ভাস্কর ব্যানার্জির ভূমিকায় দেখা যায়। অমিতাভ বচ্চনের উদ্দেশ্যে তাঁর ‘বাবু মশাই’ সম্বোধন এতটাই জনপ্রিয় হয় যে সারা দেশে বাঙালিদের সমার্থক শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হত। ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছিলেন, ধুতি পাঞ্জাবিতে রাজেশ খান্না নিজেকে বাঙালি হিসেবে বাঙালির ঐতিহ্য তুলে ধরেন সারা দেশের সামনে।
শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে কাজ করেছেন সফর,’আরাধনাবাঅমর প্রেম-এর মতো ব্লকবাস্টার ছবিতে। কলকাতায়অমর প্রেমছবির শুটিংয়ের সময় তাঁর ভক্তদের ভিড়ে প্রায় হাওড়া ব্রিজে শুটিংই করতে পারেননি পরিচালক। শেষপর্যন্ত তাঁর জন্য নকল হাওড়া ব্রিজ তৈরি করতে বাধ্য হন প্রযোজক। রাজেশ খান্না অভিনীতঅনুরোধআরখামোশিছিল বিখ্যাত বাংলা ছবিদেয়া নেয়াওদীপ জ্বেলে যাই-এর রিমেক। তপন সিনহার ক্লাসিকগল্প হলেও সত্যিথেকে তৈরি হয়েছিলবাবুর্চি`(১৯৬৬)। বলিউড অভিনেতা হিসেবে জীবনে সবথেকে বেশি বিএফজেএ(বেঙ্গল ফিল্মস জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ডস) পুরস্কারও তাঁরই পকেটে।
সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' উপন্যাসে রাজেশ খান্নার 'কাটি পতঙ্গ' ছবির উল্লেখ আছে। শক্তি সামন্ত 'অমানুষ' ছবির সঙ্গেই প্ল্যান করেছিলেন হিন্দি 'আজনবি' ছবির। 'আজনবি'র লিড রোলে ছিলেন রাজেশ। কিন্তু 'অমানুষ' এর হিন্দি-বাংলা ডাবল ভার্সনেই শক্তি নির্বাচন করেন উত্তমকুমারকে। কানাঘুষো শুরু হয় বম্বেতে। রাজেশও মনঃক্ষুণ্ণ হন। 'ছোটি সি মুলাকাতের' পর প্রায় ধ্বসে যাওয়া উত্তমও হিন্দি করতে চাইছিলেন না। কারণ এবারেও ফ্লপ মারলে বম্বেতে তাঁর সম্মান আরও খারাপ হবে। কিন্তু শক্তি সটান জানালেন মধুসূদন রায়চৌধুরীর রোলে উত্তম ছাড়া কাউকে ভাবতেই পারছেন না। উত্তম রাজি না হওয়ায় শক্তি দমে যান। তাই দেখে ফিল্ডে নামেন রাজেশই। তিনিই উত্তমকে রাজি করান।
'অমর প্রেম' করার সময়ে 'নিশিপদ্ম' প্রায় সতেরোবার দেখার পরই রাজেশ বুঝেছিলেন উত্তম কী জিনিস! বলেছিলেন -' গ্রেটেস্ট লিভিং অ্যাক্টর অন দ্য আর্থ'।
তখন 'শোলে' রিলিজ করেছে, হিন্দি 'অমানুষ'কে দেখবে! কোনো ডিস্ট্রিবিউটরই নেই। শক্তিবাবু টাকা লাগালেন। সাহায্য করলেন রাজেশ! 'অমানুষ' হল গোল্ডেন জুবিলি হিট। 'আজনবি' ও সুপারহিট হল। কলকাতার রিতজ হোটেলে(এখনকার পিয়ারলেস ইন) পার্টি দিলেন শক্তি। উত্তম-রাজেশ একসঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও রাজেশ খান্নার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। মুনমুন সেনের সঙ্গে একটা সময় খুব বন্ধুত্ব ছিল রাজেশের। মুনমুন মনে করেন, তাঁর মা আর রাজেশে নাকি অসম্ভব মিল, দু’জনেই মুডি, টেম্পারামেন্টাল, নিজেদের স্টাফেদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় এবং বর্ন স্টার।
‘আশীর্বাদ’ একটা সময় গান-হাসি-মশকরাতে টইটম্বুর থাকত। কিশোরকুমার নিয়মিত আসতেন, আরডি আসতেন। রাত ন’টা হলেই রাজেশ হাঁক মারতেন বাড়ির কাজের লোকেদের, ‘শক্তিদা আ রহে হ্যায়। মেরা ট্রে রেডি করো।’ ট্রে মানে, ট্রে-তে অবশ্যই মদের গ্লাস আর হুইস্কি।
‘আশীর্বাদ’-এ ভিড় করে থাকত বাঙালিদের গ্রুপ। শক্তি সামন্ত, কিশোরকুমার, শর্মিলা, দুলাল গুহ, অসিত সেন। এঁদের সংসর্গ রাজেশ খুব উপভোগও করতেন। বাঙালি সেই গ্রুপের আস্তে আস্তে আগমন বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর মারা গেলেন। আরডি চলে গেলেন বছরখানেক বাদে। সেই জায়গায় ঢুকে পড়েন কিছু ব্যর্থ পঞ্জাবি অভিনেতা এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রযোজক।
তখন কিশোরের গলায় রাজেশের গান আর রাহুলদেবের সুর দুর্দান্ত বক্স অফিস ছিল। রাজেশ খুব ভালবাসতেন আরডি-কে। বলতেন, ‘‘পঞ্চম মেরা কলিজা হ্যায়।’
একবার আরডির করা সুর রাজেশের পছন্দ না হওয়ায় একটা রেস্তোরাঁয় বসে ফ্যানের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের সঙ্গে তুড়ি মেরে সুর পেয়ে যান আরডি। সারা রাত না ঘুমিয়ে সুরও ভেঁজে ফেলেন। গানটা হ'ল -' শুনো হা কহো '(আপ কি কসম) । আবার 'আজনবি'র একটা গানে বৃষ্টির শব্দ রিক্রিয়েট করবেন বলে সারা রাত বৃষ্টির শব্দ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রেকর্ড করেন।
'আনন্দ ' ছবিতে রাজেশের রোলটা করার কথা ছিল প্রথমে কিশোর কুমারের। কিশোর কলকাতায় এক স্টেজ শো করতে আসেন। আর তখনই হৃষীকেশ মুখার্জী কিশোর কে ‘আনন্দ’ ছবির গল্পটা বলে তাঁকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। কিশোর কুমার এক বাক্যে রাজি হয়ে যান। কিন্তু কিশোর যে স্টেজ শোয়ে গান গাইতে আসেন, সেই স্টেজ শোয়ের কর্তা কিশোরকে কথা অনুযায়ী তাঁর টাকা দিলেন না। কিশোর ফিরে আসেন বিরক্ত হয়ে। আর বাড়ির দারোয়ানকে নির্দেশ দেন যে বাড়ির গেটে কোনো বাঙালি দেখলেই যেন খেদিয়ে দেওয়া হয়। এরপর একদিন হৃষীকেশ বাবু কিশোরের বাড়ি আসেন ‘আনন্দ’ সিনেমার পাকা কথা বলতে আর তাঁর পারিশ্রমিকের কিছু অংশ অগ্রিম দিতে। বাধ সাধল বাড়ির দারোয়ান। হৃষীকেশ বাবু যে বাঙালি সেটা বুঝতে পেরে দারোয়ান তাঁকে ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা, একেবারে তাড়িয়ে দিল। কিশোর কুমারের আর ‘আনন্দ’ ছবিতে অভিনয় করা হয়নি।
রাজেশ তখন সাম্রাজ্য একেবারে হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু মধ্য বয়সে আবার একটা হিট পেয়ে যান - 'আলাগ আলাগ'। পরিচালক শক্তি সামন্ত আর প্রযোজক রাজেশ নিজেই। এ-ছবির গান গেয়ে এক পয়সাও নেননি কিশোর। কারণ রাজেশের 'আরাধনা'র পর প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে সবচেয়ে বড়ো ব্রেক তিনি পেয়েছিলেন।
তাই রাজেশের প্রযোজিত প্রথম ছবিতে তাঁর কোনো পয়সা নেওয়ার অধিকার নেই।
পরে এর দারুণ প্রতিদান দেন রাজেশ। কিশোর প্রযোজিত 'মমতা কি ছাও মেঁ'-তে গেস্ট রোল করার জন্য কিশোর বলেছিলেন খ্যাতির চূড়ায় থাকা অমিতাভ বচ্চনকে। অমিতাভ না করায় ক্ষুব্ধ কিশোর অমিতাভের প্লেব্যাক করা বন্ধ করে দেন। সেই রোলটা করেন রাজেশ। তখন তিনি বলিউড থেকে একপ্রকার বিলীন। তা সত্ত্বেও কিশোরের থেকে পারিশ্রমিক নেন মাত্র এক টাকা। ছবির নায়ক ছিলেন অমিত কুমার। মাঝপথে কিশোর হঠাৎ মারা গেলে অমিতই বাকিটা শেষ করেন। রাজেশ এগিয়ে এসে ছবিটা রিলিজ করতে সাহায্য করেন। রাজেশের লিপে প্রায় আশিরও বেশি গান আছে কিশোরের। রাজেশের লিপে মাত্র কয়েকটা কালজয়ী গান গেয়ে গেছেন মান্না দে-ও।
মধ্য বয়সে রাজেশের করা আরও একটা ছবি ব্লকবাস্টার হিট হয়েছিল। স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্স করে রাজেশ আবার আলোচনায় চলে আসেন। কিন্তু তিনি ছবির নায়ক ছিলেন না, ছিলেন এক বাঙালি তরুণ যিনি কিছুদিন পরই বলিউডের অবিস্মরণীয় সম্রাট হয়ে উঠবেন। তিনি মিঠুন চক্রবর্তী। ছবির নাম 'ডিস্কো ডান্সার'। মিঠুনের সঙ্গে বেশ কয়েকটা ছবি করেছেন রাজেশ। এমনকি পরের দিকে মিঠুনের থেকে বিখ্যাত হওয়া জুলফিবিহীন চুলের ছাঁটেও নিজেকে বদলে ফেলেন।
এভাবেই, ‘সুপারস্টার’ রাজেশের সাফল্যের পিছনে বারবার উঠে এসেছে বাঙালিদের নাম। ভাবুন তো, এঁরা না থাকলে, রাজেশ খান্নাও কি খ্যাতির শীর্ষে উঠতে পারতেন কোনোদিন?
Powered by Froala Editor