“গানের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে তো স্বর্ণযুগকে বাদ দিয়ে আমরা এগোতেই পারি না। তাই ওই সময়টার প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে।” বলছিলেন শুভজিৎ সরকার (Shubhajit Sarkar)। যাঁর উদ্যোগে এবং সংকলনে আবারও প্রকাশিত হতে চলেছে বেশ কিছু লাইভ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং। এর আগেও পেরিনিয়াল রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সংকলিত একাধিক অ্যালবাম। মাত্র ২২ বছর বয়সেই বাংলা গানের ইতিহাস চর্চার একটা অন্য দিক খুলে দিচ্ছেন শুভজিৎ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay), বাংলা গানের জগতে একজন মহীরুহ বললেও হয়তো কম বলা হয়। তবে তাঁর রেকর্ড করা গানগুলির বাইরে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বেশ কঠিন। অথচ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো শুধুই গান রেকর্ড করে শিল্পীর মর্যাদা পাননি। তার অনেক আগে গণনাট্য সংঘে থাকার সময়েই গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছেন। এমনকি শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও বহু আসরে গান গেয়েছেন। রেডিও বা দূরদর্শনের অনুষ্ঠান তো ছিলই। এছাড়াও ছিল নাগরিক উদ্যোগে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠান। মফস্সলে একসময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নাইট অনুষ্ঠান পর্যন্ত হয়েছে রমরমিয়ে।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এমন সমস্ত অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং রাখা বেশ সহজ। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সময়ে তো তেমনটা ছিল না। শুভজিৎ জানালেন, তিনি বিগত ৬ বছর ধরে এই সমস্ত গান সংগ্রহ করে চলেছেন। কীভাবে সংগ্রহ করছেন গান? তাঁর কথায়, “তখনও অনেকেই অনুষ্ঠানের সময় ক্যাসেটে রেকর্ড করে রাখতেন। কিছু কিছু ভিডিও রেকর্ডিংও করা হত। মানুষের কাছে গিয়ে সেইসব রেকর্ডিং সংগ্রহ করি।” তবে কাজটা সেখানেই শেষ হয়ে যায় না। এরপর চলে সেইসমস্ত রেকর্ডিং ডিজিটালাইজ করার কাজ। ভিডিও রেকর্ডিং ডিজিটালাইজ করার ক্ষেত্রে টেকনিশিয়ানদের সাহায্য নিতে হয় তাঁকে। তবে অডিও ক্যাসেট থেকে ডিজিটাল কপি তৈরি করেন শুভজিৎ নিজেই।
নিমতা অঞ্চলে বসবাস করেন তরুণ শুভজিৎ। সদ্য ক্ষুদিরাম বসু সেন্ট্রাল কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এই বয়সেই তাঁর উদ্যম রীতিমতো অবাক করে। শুভজিৎ জানালেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর আগ্রহ গড়ে ওঠে আরও বছর দশেক আগে। “তাঁর আত্মকথন ‘আনন্দধারা’ পড়ার পরেই মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এরপর ঠিক করেছিলাম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত গান শুনে ফেলব।” সেই শুরু। রেকর্ডিং-এর গানগুলো শুনতে শুনতেই এরপর রেকর্ডিং-এর আড়ালে থেকে যাওয়া গানের হদিশ খুঁজতে থাকেন তিনি। আর শুভজিতের এই আগ্রহে ইন্ধন জুগিয়েছেন হেমন্ত গবেষক জয়দীপ চক্রবর্তীও।
বিভিন্ন অপ্রকাশিত গানের রেকর্ড খুঁজে পাওয়ার পরেই সেগুলো প্রকাশ করার তাগিদও অনুভব করেন শুভজিৎ। আর তাঁর এই উদ্যোগে সাগ্রহে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন পেরিনিয়াল রেকর্ডসের কর্ণধার প্রদীপ্ত রায়। এইসমস্ত অমূল্য রত্নের মধ্যে রয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লোকগীতি ‘আমি আছি কোথায়, যাব কোথায়’। রয়েছে বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতও। আবার সম্প্রতি মুক্তি পেতে চলেছে ‘দুর্লভ’ নামের আরেকটি সংকলন। তাতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটির হিন্দি সংস্করণও থাকবে। শুভজিতের এই উদ্যোগ আগামীদিনে আরও প্রসারিত হয়ে বাংলা গানের ইতিহাস চর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করবে, এই প্রত্যাশা রাখাই যায়।
Powered by Froala Editor