বাঙালি গোয়েন্দা বলতে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, মিতিন মাসি— এই নামগুলিই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তবে আশি, নব্বই কিংবা প্রথম দশকে বড়ো হয়ে ওঠা অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীদের কাছেই প্রিয় বাঙালি গোয়েন্দার তালিকায় ছিল বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু-বিচ্চুরা এবং অবশ্যই পঞ্চু। মানুষ না হলেও, রহস্য সমাধানে এই কানা চতুষ্পদটির অবদানও কি কম নাকি?
পাণ্ডব গোয়েন্দা। বাংলার এই ‘পঞ্চ পাণ্ডব’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল এই কিশোর সাহিত্যজগতে। এবার অভিভাবক হারাল তারা। প্রয়াত হলেন ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’-র স্রষ্টা তথা বিশিষ্ট সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় (Sasthipada Chattopadhyay)। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন অশীপিতর সাহিত্যিক। গত রবিবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ভর্তি করা হয়েছিল হাওড়ার একটি হাসপাতালে। শুক্রবার সকাল ১১টা নাগাদ সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
১৯৪১ সাল। হাওড়ার খুরুট ষষ্ঠীতলায় জন্ম ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের। কিশোর বয়স থেকে তাঁকে কাছে টেনেছে অ্যাডভেঞ্চার। ঘুরে বেড়ানো একরকম নেশাই ছিল তাঁর। সাধু-সঙ্গও করেছেন কৈশোরে। সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলত সাহিত্যচর্চা। বিশেষভাবে তাঁকে আকর্ষণ করত রহস্য-রোমাঞ্চের গল্প-উপন্যাস। কলমও ধরেছিলেন অল্প বয়সেই। আর তার সুবাদেই ১৯৬১ সালে বাংলার প্রথম সারির একটি সংবাদপত্রে কাজ জুটে যায় তাঁর। সংবাদপত্রের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত সাহিত্য-রচনা।
১৯৭০ সাল। মাসিক শুকতারা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’। রহস্য-আখ্যান বুনতে প্রাপ্তবয়স্ক গোয়েন্দাদের পাশে সরিয়ে, কিশোর চরিত্রদেরই বেছে নিয়েছিলেন ষষ্ঠীপদ। বাবলু-বিলু-ভোম্বল-বাচ্চু-বিচ্চু… সকলেই তারা স্কুল-পড়ুয়া, হাওড়ার বাসিন্দা। প্রথম গল্পের প্লটও হাওড়াই। তবে পরবর্তীতে নিজের অঞ্চল ছেড়ে দুষ্টদমন আর রহস্য অনুসন্ধানের নেশায় ধীরে ধীরে ভিন রাজ্যে পাড়ি জমায় পঞ্চ পাণ্ডব।
শুকতারায় প্রকাশিত ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ কাহিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কিশোর পাঠক-মহলে। শুকতারা ছাড়াও আনন্দমেলার পাতাতেও জায়গা করে নিয়েছিল এই কিশোর-রোমাঞ্চ কাহিনি। ১৯৮১ সালে প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয় ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’-র উপন্যাস। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ষষ্ঠীপদকে। বরং, খুদে পড়ুয়াদের চাহিদা মেটাতে একের পর এক প্লট তৈরি করতে হয়েছে তাঁকে। সবমিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ৩০টিরও বেশি গ্রন্থ।
শুধুই কি বই? কমিক স্ট্রিপ, অ্যানিমেশন, এমনকি হালের আমলে ছোট পর্দার ধারাবাহিকেও জায়গা করে নিয়েছিল পাণ্ডব গোয়েন্দা কাহিনি। সবমিলিয়ে বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে বেঁধে রেখেছে এই কিশোর গোয়েন্দা চরিত্রগুলো। যদিও ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’-র ধারাবাহিক নিয়ে খুশি ছিলেন না স্বয়ং স্রষ্টা। কাহিনিতে একাধিক প্রেমজ ইঙ্গিত ও রোম্যান্টিক ঘনিষ্ঠতা দেখে, দুঃখের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন, ‘আমার লেখক জীবনের দুর্ভাগ্য, আমাকে শেষ বয়সে এটা দেখে যেতে হল’।
‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’ ছাড়াও কিশোর গোয়েন্দা ‘তাতার’, প্রাইভেট ডিটেক্টিভ ‘অম্বর চ্যাটার্জ্জী’-সহ আরও একাধিক চরিত্র রচনা করেছেন ষষ্ঠীপদ। ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’-র মতো সর্বজনীন না হয়ে উঠতে পারলেও, এ-সকল গোয়েন্দা চরিত্রের জনপ্রিয়তা কম নয় মোটেই। এমনকি গোয়েন্দা তাতারকে নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। সাহিত্যজগতে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।
গতবছরই না-ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন কিশোর সাহিত্যের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব নারায়ণ দেবনাথ। এবার ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আরও এক স্তম্ভ হারাল কিশোর সাহিত্যের দুনিয়া। শোকস্তব্ধ পাঠকমহল…
Powered by Froala Editor