সকলের অপ্রত্যাশিত। মঙ্গলবার বিকালে আরও এক হঠাৎ দুঃসংবাদে যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল কলকাতা। আরও এক নক্ষত্রপতন বাংলায়। প্রয়াত হলেন কথা-সাহিত্যিক, গবেষক এবং অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
জন্ম নদীয়ার দিগনগরে। তবে কলকাতার সঙ্গে ছোট থেকেই ছিল এক আত্মার সম্পর্ক। কিশোর বয়স থেকেই বেড়ে ওঠা হাওড়ার শিবপুরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই করেছেন গবেষণা, পিএইচডি। তারপর পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে।
১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণনগর গভার্নমেন্ট কলেজে অধ্যাপনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের। দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পরও ছেদ পড়েনি শিক্ষকতার সঙ্গে। অবসরের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছর তুলনামূলক সাহিত্যে ক্লাস নিয়েছেন তিনি। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজে স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগে পড়িয়েছেন অতিথি অধ্যাপক হিসাবে।
তবে কাজের সূত্রে কলকাতা, কৃষ্ণনগরের মতো শহুরে অঞ্চলে জীবন কাটাতে হলেও চিরকালই গ্রাম-বাংলার প্রতি ছিল নাড়ির টান। গবেষণা হোক কিংবা লোক-সমাজ, উপজাতিদের যাপনচিত্র অনুসন্ধানে বারবার তিনি ছুটে গেছেন প্রান্তিক অঞ্চলে। দিন কাটিয়েছেন মাটির গন্ধ ঘেঁষা মানুষদের সঙ্গে। বিশেষ করে লোকসংস্কৃতি, লোক সঙ্গীতের ওপর করেছেন দীর্ঘ অনুসন্ধান। রবীন্দ্রনাথ থেকে লালন, বাউল সংস্কৃতি থেকে গ্রাম বাংলার মৃৎশিল্প, চিত্রকলা সবকিছুই বারবার হয়ে উঠেছে তাঁর গবেষণার বিষয়। গবেষণা ও রচনার পাশাপাশি করেছেন দীর্ঘদিন সম্পাদনার কাজও। কৃষ্ণনগর থেকে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি ও মননের পত্রিকা ধ্রুবপদ।
৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন সুধীর চক্রবর্তী। গবেষণামূলক প্রবন্ধের পাশাপাশি লিখেছেন মৌলিক রচনা এবং আখ্যান্ধর্মী বেশ কিছু গ্রন্থ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গভীর নির্জন পথে’, ‘লালন’, ‘পঞ্চগ্রামের কচড়া’, ‘আখ্যানের খোঁজে’, ‘বুদ্ধিজীবীর নোটবই’, ‘রবিকর রেখা’, ‘বাউল ফকির কথা’ প্রভৃতি।
‘বাউল ফকির কথা’ গ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। ২০০৪ সালে এই বইটির জন্য সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারের সম্মাননাও পান সুধীর চক্রবর্তী। তাছাড়াও শিরোমণি পুরস্কার, দীনেশ চন্দ্র সেন পুরস্কার, নরসিংহ দাস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অক্লান্ত অধ্যাপনাজীবনের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছে সরোজিনী নাইডু স্বর্ণপদক এবং ‘বিশিষ্ট অধ্যাপক’ খেতাবে।
আরও পড়ুন
প্রকাশ্যে এনেছিলেন ঠান্ডা যুদ্ধের পটভূমি, প্রয়াত কিংবদন্তি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জন লি ক্যারে
শহুরে জীবনের সঙ্গে গ্রাম বাংলার প্রকৃতির মধ্যে বন্ধনের সেতু নির্মাণ করেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। বাংলার মননে সংস্কৃতির জাল বুনে দিতে শেষ বয়স অবধি কলম ধরে রেখেছিলেন তিনি। বার্ধক্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েও চালিয়ে গেছেন সাহিত্যরচনার কাজ। এসবের মধ্যেই হঠাৎ যে ছুটি নেবেন তিনি, তা যেন সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত। কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিকের মৃত্যুসংবাদে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাংলার পাঠকমহলে...
Powered by Froala Editor