বর্ণবিদ্বেষের শিকার প্রবাসী বাঙালি কিশোর, ‘আত্মহত্যা’র পিছনে লুকিয়ে কোন রহস্য?

বর্ণবিদ্বেষ— সেই কোন ইতিহাস থেকে এই শব্দটি পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! কালো, বাদামি চামড়ার মানুষদের ওপর এর আগেও নানা সময় নানা অত্যাচার হয়েছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরই আরও বেশ কিছু ঘটনা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। এত আন্দোলন, এত মিছিলের ফল কী হবে? এমন প্রশ্নই তুলছেন অনেকে। সেই প্রসঙ্গেই ফিরে এল এক বছর আগের একটি মর্মান্তিক ঘটনা। বছর বারোর এক প্রবাসী বাঙালি ছেলের মৃত্যুর ঘটনা, যার পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল অত্যাচার এবং বর্ণবিদ্বেষ।
 

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসল ঘটনা সামনে এনেছেন ছেলেটির মা, দূর্বা মুখোপাধ্যায়। কানাডার ডেভিসভাইলে চাকরিসূত্রে থাকছিলেন তিনি। ছেলে অর্ক মুখোপাধ্যায়কে একাই বড়ো করছিলেন। আসল ঘটনার সূত্রপাত ২০১৮ সাল থেকে। স্কুল হোক বা খেলা— সবসময় তাঁর ছেলেকে উত্যক্ত করত আরও কয়েকজন। রীতিমতো ভয় দেখিয়ে স্কুলের কাজ করিয়ে নেওয়া, বিনামূল্যে নেট ব্যবহার করে নেওয়া— সমস্ত কাজই চলত। এদিকে তাদের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে উঠবে না দেখে ছেলেও কিছু বলত না। এভাবেই চলছিল সবটা। অত্যাচার, অপমানের সীমা একটু একটু করে বাড়ছিল। ঘটনাচক্রে, এরা সবাই ‘সাদা চামড়ার’… 

ঘটনা জটিল হতে শুরু করল ২০১৮-এর শেষের দিক থেকে। ওই ছেলেগুলো অর্ক-র সমস্ত খেলার বল কেড়ে নিয়ে নিজেরা খেলেছে, আর হারিয়ে ফেলেছে। সেটা চাইতে গেলে ওই গ্রুপেরই আরেক ছেলের মা শুধু অর্ককেই নয়, দূর্বাদেবীকেও অপমান করেন। অবাক ব্যাপার হল, ওই ছেলেটিও বাঙালি! যাই হোক, এর পরের দিন থেকে শুরু হল হুমকি দেওয়া। স্কুলে যাওয়ার পথে সবসময় দুজন ছেলে মিলে অর্ককে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার কথা বলে গেল। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলা হলে, তাঁরা কোনোরকম ব্যবস্থাই নিল না! ফলস্বরূপ, কয়েকদিনের মধ্যেই ‘উচিত শিক্ষা’ পেল অর্ক। ওই দুজন মিলে ভয়ংকরভাবে মারল ওকে। তারপর বাড়ির সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে গেল! ‘স্পর্ধা’ দেখানোর শাস্তি… 

এইভাবেই ঘটনা বাড়তে থাকে। শুধু মারধোরই নয়, অর্ক এবং তার মায়ের নামে মিথ্যে বদনাম ছড়ানো হয় এলাকায়। একবছর ধরে এমন চলতে থাকে। অথচ স্কুল কিচ্ছু করেনি! বরং সবকিছুতে অর্কের ওপরই দোষ এসে পড়েছে। সে-ই আসল অপরাধী, এমনটাই বলেছে স্কুল। কিন্তু কেন? উত্তর খুঁজছিলেন সবাই। উল্টোদিকে অর্ক’র মনের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, সেটাও দূর্বাদেবী ছাড়া ভেবে দেখছিলেন না কেউ। ক্রমাগত অত্যাচার, অপমান, মারধোরের বোঝা আর নিতে পারেনি সে। শেষ পর্যন্ত ২০১৯-এর ২১ জুন অর্ক ঘর থেকে বেরোয়; কাছেই এক বন্ধুর বাড়ি যাবে এমনটাই বলেছিল। কিন্তু দুঘণ্টা কেটে গেল, অর্ক আসেনি। শেষ পর্যন্ত এল পুলিশের ফোন। কাছেই একটি বহুতলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে অর্ক মুখোপাধ্যায়। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু… 

আরও পড়ুন
মাথায় বিদ্যুৎ দিয়ে ‘হত্যা’, মিথ্যা অভিযোগে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল এই কৃষ্ণাঙ্গ বালকের

এটা কি আত্মহত্যা? তেমনটাই ভেবেছিলেন অনেকে। কিন্তু এর পেছনে যে আরও অনেক রহস্য আছে সেই কথাটাই আজও বলে যাচ্ছেন দূর্বা মুখোপাধ্যায়। কারণ ওই বহুতলেই থাকে অর্ক’র সেই ‘বন্ধু’, যার হাতে বারবার অপমানিত হয়েছিল সে। কিন্তু পুলিশ কোনো কথা শুনতে রাজি ছিল না। এখনও সব কথা প্রকাশ্যে আনেনি তাঁরা। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও বেশ কিছু ভুল বেরিয়ে এসেছিল। শত অনুরোধেও ফরেন্সিক টেস্ট করা হয়নি। এই ব্যাপারটি নিয়ে কানাডার মিডিয়াতেও সেরকম খবর বেরোয়নি। সমস্ত জায়গায় বয়ান একই। তদন্তও এগোয়নি। এতদিন ধরে এত অত্যাচারের বিচারও হয়নি। শেষ পর্যন্ত অর্কই চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে… 

আরও পড়ুন
প্রতিবাদের আগুন ছড়াল ব্রিটেনে, ভাঙা হল দাস ব্যবসায়ীর মূর্তি, রেহাই নেই ‘রেসিস্ট’ চার্চিলেরও

বর্ণবিদ্বেষ এভাবেই লুকিয়ে আছে সমস্ত ক্ষেত্রে। গায়ের রং কালো বা বাদামি হলেই অত্যাচারের শিকার হতে হবে, এমনটাই যেন নিয়তি। কখনও ফেয়ারনেস ক্রিমের অ্যাডে মুখ ঢাকতে হয়, কখনও নানা বিশেষণের বোঝা নিয়ে চলতে হয়। নয়তো অপেক্ষা করে থাকে অর্কদের মতো পরিণতি। আন্দোলন, মিছিল, প্রতিবাদ অবশ্যই জরুরি; কিন্তু তাতেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে? আমাদের শিকড়েই যে ঢুকে আছে সাদা-কালোর বিভেদ।

আরও পড়ুন
‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ – বর্ণবৈষম্য মুছে আমেরিকাকে ‘মানুষ’ করতে চেয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং

Powered by Froala Editor