“পাখিরা বিভিন্ন ফল খেয়ে তার দানা ছড়িয়ে দেয়। সেখান থেকেই কিছু গাছ গজিয়ে ওঠে। আমরাও এই পদ্ধতিতে বৃক্ষরোপণ করতে পারি। ইতস্তত ফলের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারি অরণ্য। বাকিটা প্রকৃতি নিজেই করে নেবে।”
বলছিলেন আমতলার পীরতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক পিনাকী গুহ। পরিচর্যা ছাড়াই অরণ্য তৈরির এই পদ্ধতির সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত আমরা সকলেই। গেরিলা গার্ডেনিং। চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ইউরোপের একাধিক দেশেই প্রচলিত এই বৃক্ষরোপণ পদ্ধতি। ভারতই বা বাদ যায় কেন? পিনাকীবাবুর হাত ধরেই এবার কলকাতার বুক চলছে গেরিলা গার্ডেনিং।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার পৈলান থেকে শুরু করে নেপালগঞ্জ— এই গোটা অঞ্চল জুড়েই রাস্তার দু’ধারে বিভিন্ন ফলের বীজ ছড়িয়েই আষাঢ় উদযাপন করলেন পিনাকীবাবু। তবে এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এই প্রথম নয়। বিগত ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছরই এমন এক কর্মকাণ্ড করে আসছেন তিনি। তাঁর এই কর্মসূচিতে জুড়ে যায় তাঁর ছাত্রেরাও। তবে এবছর মহামারীর কথা মাথায় রেখে একাই লড়াইতে নেমেছেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ এমন একটি পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া কেন? “পৈলানে গেলে দেখতে পাবে চারিদিকে জলাজমি বুজিয়ে বাড়ি উঠছে। আজ থেকে পনেরো বছর আগেও ছবিটা এমন ছিল না। এই উন্নয়নকে তো আর আটকে রাখা যায় না। ফলে পরিবেশ বাঁচাতে গাছের বিকল্প নেই। কিন্তু অন্যের জমিতে তো গাছ লাগানো যায় না। তাই এটাই একমাত্র পথ। ফলে বীজ ছড়িয়ে দিলে বাকি কাজ প্রকৃতি নিজেই করে নেবে”, উত্তর দিলেন পিনাকীবাবু।
আরও পড়ুন
গাছের পাতা থেকেই স্যানিটাইজার! আশ্চর্য দাবি উত্তরবঙ্গের গ্রামের!
বছর তিনেক আগে গেরিলা গার্ডেনিং-এর ব্যাপারে তিনি প্রথম জেনেছিলেন চেতলার অ্যাডভোকেট মন্টু হাইতের কাছে। আলিপুরের কাছে পোর্ট ট্রাস্টের বিস্তীর্ণ জমি পড়ে থাকলেও, সেখানে গাছ লাগানো আইনত অপরাধ। কিন্তু বীজ ছড়িয়ে দিতে তো নিষেধাজ্ঞা নেই কোনো। ফলে গেরিলা গার্ডেনিংকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বিগত ১১ বছরে তাঁর হাতেই জন্ম নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার বৃক্ষ। তাঁর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই পথে হাঁটা পিনাকীবাবুর।
আরও পড়ুন
দুই সহস্রাধিক গাছের অভিভাবক তিনি, বার্ধক্যও দমাতে পারেনি পুরুলিয়ার দুখু মাঝি-কে
আগামী শ্রাবণ মাসের প্রথম দিনেও একইভাবে গেরিলা গার্ডেনিং-এর উদ্যোগ নেবেন বলেই জানালেন তিনি। শুধু বীজ নয়, সযত্নে কিছু চারাও তৈরি করেছেন পিনাকীবাবু। সেগুলিও সামনের মাসে রোপণ করবেন তিনি। “মূলত গোলাপজাম গাছের চারা তৈরি করে রেখেছি বেশ কিছু। সেগুলো একটু বড়ো হলেই রোপণ করা হবে। এই ফলটি আম, জাম বা কাঁঠালের মতো এতটা সহজলভ্য নয়। বেশ দামিও। সে জন্যই এই পন্থা। নাহলে চারা পরিণত হওয়ার আগেই গরু-ছাগলে তা নষ্ট করে দিতে পারে।”
আরও পড়ুন
কন্যাজন্মের আনন্দে ১১১টি বৃক্ষ রোপণ, এমনই রীতি রাজস্থানের গ্রামে
তবে এবছর ছাত্ররা না থাকলেও একা নন তিনি। দূরে থেকেও তাঁর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে তাঁর পাশে সামিল হয়েছেন বাংলাদেশ এবং কাশ্মীরের সঙ্গীরা। বাংলাদেশের সোফি হারেসি, ইসলাম মহম্মদ, আসিফ সাদিল এবং কাশ্মীরের সুজা আব্বাস— তাঁরাও পৃথকভাবে গেরিলা গার্ডেনিং-এর উদ্যোগ নিয়েছেন নিজের নিজের এলাকায়। সব মিলিয়ে চলছে সবুজায়নের এক অদ্ভুত উৎসব।
কলকাতা তো বটেই, গোটা ভারতের বুক থেকেই ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে সবুজের আধিক্য। নগরায়ণের গতি কংক্রিটের চাদরে মুড়ে ফেলছে জমিকে। তবে নতুন করে তাঁর প্রাণ সঞ্চার করা একেবারেই যে অসম্ভব— তেমনটা নয়। বিরূপ বর্ষাযাপনের মধ্যে দিয়েই সেই পথে হদিশ দেখাচ্ছেন পিনাকী গুহ। তাঁর দেখানো রাস্তায় আমরাও কি এগিয়ে আসতে পারি না? সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রুত বদলে দিতে পারে প্রকৃতির চেহারা। তাতে লাভ হবে আখেরে আমাদেরই। সকলের কাছে সেই আবেদনই রাখছেন বাংলার এই শিক্ষক…
Powered by Froala Editor