বন্ধ স্কুল, থেমে নেই প্র‍্যাকটিক্যাল ক্লাস, নেপথ্যে বাখরাহাটের শিক্ষক

ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা কাঠের টেবিল। তাতে কোনো মতে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটা পিপেট, ব্যুরেট, টেস্টটিউব, ফ্লাস্ক আর বিকারকের কিছু বোতল। সেই টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে খান ছয়েক কিশোর, কিশোরী। বয়স আন্দাজ ষোলো কি সতেরো। দেখলেই বোঝা যায়, বাড়িতে বসেই রসায়নের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে জোর কদমে। কোনো সায়েন্স প্রোজেক্ট করছে নাকি তারা? না, তেমন নয় ব্যাপারটা। আসলে এই ছোট্ট ঘরেই চলছে রসায়নের ক্লাস (Chemistry Class)। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস (Practical Class)। এবং সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই সেই সুবিধা পাচ্ছেন পড়ুয়ারা।

“আমি একটা গ্রামের স্কুলে পড়াই। এখানে পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধাও অতটা বেশি পায় না ছাত্ররা। লকডাউনে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই কারণেই ভেবেছিলাম আমার বিষয়টায় অন্তত আমার দিক থেকে যেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিতে পারি”, বলছিলেন বাখরাহাটের বাসিন্দা তথা দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিষ্ণুপুর থানার রামনগর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু মজুমদার (Krishnendu Majumder)। হ্যাঁ, এই ল্যাবরেটরি এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের নেপথ্যে রয়েছেন তিনি। 

২০২০ সালের মার্চ মাসের কথা। মহামারীর প্রকোপ ঠেকাতে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সমস্ত স্কুল-কলেজ। গত বছরের শেষের দিকে সাময়িকভাবে স্কুলের দরজা খুললেও আবার তালা পড়ল চলতি সপ্তাহে। নিওনর্মাল এই পরিস্থিতিতে বর্তমানে কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনই হয়ে উঠেছে ‘ক্লাসরুম’। তবে সবথেকে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় প্রথাগত পড়াশোনার বাইরে হাতে-কলমে পরীক্ষানিরীক্ষাও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ শিক্ষাগ্রহণের। বাড়িতে বসে ছাত্রছাত্রীদের সেই সুযোগ কোথায়? তাহলে কি পরবর্তীতে স্কুলের শিক্ষা ‘অসম্পূর্ণ’ রেখেই তাদের ভর্তি হতে হবে কলেজে? 

আরও পড়ুন
কাশ্মিরি শালের আদলে নকশিকাঁথা, নেপথ্যে বাঙালি শিক্ষক

এই সমস্যার সমাধান খুঁজতেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ল্যাবরেটরি তৈরির ব্যাপারে চিন্তা শুরু করেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। রিয়েজেন্ট কিংবা যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাও করে ফেলেন নিজেই। ল্যাবরেটরি ঠিকঠাক চলছে কিনা কিংবা আদৌ বিপদের কোনো আশঙ্কা আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখেন আরও কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে। পড়ুয়াদের নিরাপত্তার বিষয়টাও তো মাথায় রাখতে হবে। সব ঠিকঠাকই ছিল। শুধু বাধ সাধল জায়গার অভাব। কৃষ্ণেন্দুবাবু জানালেন, “পুজোর পর থেকেই রুম খুঁজছিলাম আমি। শেষ পর্যন্ত আমারই এক ছাত্র সহার্ষ, তার বাড়িতে কথা বলে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়। জায়গাটা আমতলার একদম কাছেই। ফলে যাতায়াতেরও খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।” ছোট্ট সেই ঘরে আস্ত একটা ল্যাবরেটরি তৈরি করার মতো খুব বেশি জায়গা নেই ঠিকই, তবে তার মধ্যেই পরিপাটি করে সরঞ্জাম সাজিয়েছেন বাখরাহাটের শিক্ষক। যাতে অনায়াসেই কাজ করতে পারেন ৫-৬ জন শিক্ষার্থী। এভাবেই পালা করে ক্লাস চলছে ছাত্রছাত্রীদের। 

আরও পড়ুন
মাটির দেওয়ালই ব্ল্যাকবোর্ড, গোটা গ্রামকেই ক্লাসঘর বানিয়ে নজির শিক্ষকের

Image Caption

 

আরও পড়ুন
‘সন্তানকে শিক্ষিত সাইকোপ্যাথ বানাবেন না’, আর্জি হলোকাস্ট-ফেরত শিক্ষকের

আর বিনামূল্যেই এই গোটা পরিষেবাটা দিচ্ছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। “যে সব ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের জন্যই এই বন্দোবস্ত। তবে ক্লাস করার জন্য আমার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করছে বর্তমানে। তাদের ক্ষেত্রেই কোনো বাঁধা ধরা ফি নেই। যার যেমন সামর্থ্য, স্বেচ্ছায় তেমন অনুদান দিতে পারে”, জানালেন তিনি। কিন্তু খরচ? আস্ত একটা রসায়নের ল্যাবরেটরি চালানো তো আর মুখের কথা নয়। কীভাবে চলছে এই কর্মকাণ্ড? বলতে গেলে নিজের সঞ্চয় ভাঙিয়েই তিলে তিলে এই ল্যাবরেটরি গড়ে তুলেছেন তিনি। সেইসঙ্গে পাশে দাঁড়িয়েছিল সহার্ষ, সৌম্যদীপ, অগ্নি, স্নেহা, সুদীপ্তা, টিসিতা, সৃজা এবং ঐশীর মতো একদল বন্ধুস্থানীয় ছাত্রছাত্রী। কৃষ্ণেন্দুবাবুর কথায়, “এই উদ্যোগের পিছনে ওদের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।”

বিগত কয়েকমাস ধরেই স্বমহিমায় চলছে এই ল্যাবরেটরি। কৃষ্ণেন্দুবাবুর আর্জি শুধু একটাই, তাঁর মতো অন্য শিক্ষকরাও যেন এগিয়ে আসেন এহেন কর্মকাণ্ডে। রসায়নের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা কিংবা জীববিজ্ঞানেরও এইরকম ল্যাবরেটরি গড়ে উঠুক প্রান্তিক অঞ্চলে, দু’চোখে সেই দিনবদলের স্বপ্নই দেখছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। একদিন না একদিন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবেই। বাঙালি শিক্ষকের এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানানোর সত্যিই বোধ হয় ভাষা হয় না কোনো…

Powered by Froala Editor

Latest News See More