“বর্তমানে পিএইচ স্কেলে সামুদ্রিক জলের অম্লতা ৮.১। ২১০০ সালের মধ্যে যা পৌঁছাবে ৭.৮ মাত্রায়। সামুদ্রিক অম্লতার এই তারতম্য আপাতদৃষ্টিতে উপেক্ষণীয় হলেও, তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে সামুদ্রিক পরিবেশে। বাস্তুতন্ত্র তো বটেই, প্রভাবিত হবে ফিশারি কিংবা পর্যটন শিল্পও।”
বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তথা সমুদ্র গবেষক ডঃ সুমিত মণ্ডল। শুধু স্থলজ প্রাণীজগৎ-ই নয়, বায়ুদূষণের (Air Pollution) জেরে ক্রমশ বিপন্নতার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রও (Marine Ecosystem)— এবার সেটাই প্রমাণ করে দেখালেন ডঃ সুমিত মণ্ডল এবং গবেষক শ্রীতমা বাগ। গবেষণাগারে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে দেখালেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের প্রভাব সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া, প্রবাল, ঝিনুক-সহ একাধিক প্রাণীকে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এও কি সম্ভব? সামুদ্রিক পরিবেশে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড? ডঃ মণ্ডলের কথায়, “পরিবেশে নির্গত হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ৩১ শতাংশই শোষিত হয় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে। যা জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে কার্বনিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডের জন্যই অম্লতা বাড়ছে সমুদ্রের জলের। সামুদ্রিক প্রাণীদের বিপন্নতার কারণও এই অ্যাসিডই।”
শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি বা লবস্টার— এসকল সামুদ্রিক প্রাণীদের খোলস, অর্থাৎ বাইরের আস্তরণ তৈরি হয় ক্যালশিয়াম কার্বনেট দিয়ে। সামুদ্রিক পরিবেশে অম্লতা বা অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধির পাওয়ার জন্য দ্রুত ক্ষয়ীভূত হয় এই আস্তরণ। খোলস পাতলা হয়ে যাওয়ার কারণে, অতি-সহজেই তারা শিকার হয়ে ওঠে বৃহত্তর সামুদ্রিক প্রাণীর। শুধু তাই নয়, অম্লতার কারণে খোলসযুক্ত সামুদ্রিক প্রাণীর বৃদ্ধি এবং বংশবিস্তারও প্রভাবিত হচ্ছে বলেই জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক।
“এইসব প্রাণীদের বাইরে, যে-কোনো সামুদ্রিক মাছের কঙ্কাল বা মেরুদণ্ডও ক্যালশিয়াম কার্বনেটে তৈরি। তাছাড়া ভোলা, সার্ডিন-সহ বিভিন্ন মাছের মাথায় পাথরের মতো একটি পদার্থ পাওয়া যায়। ক্যালশিয়াম কার্বনেটে তৈরি অটোলিথ নামের এই অঙ্গটি মাছকে ইকোলোকেশনে সাহায্য করে। অম্লতার বৃদ্ধির কারণে, ব্যাহত হচ্ছে সেটিও”, জানালেন সুমিত।
এর আগেও একাধিক গবেষণা জানিয়েছিল, কার্বনিক অ্যাসিডের কারণে ক্যালশিয়াম কার্বনেটের আস্তরণ ক্ষয়ীভূত হয় সামুদ্রিক প্রাণীর দেহে। তবে ভারতে এই সর্বপ্রথম পরীক্ষাগারে তা প্রমাণ করে দেখালেন সুমিত-শ্রীতমা। সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত বেশ কিছু কাঁকড়ার ওপর চালানো হয়েছিল এই পরীক্ষা। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছিল ৭.৭ পিএইচ মাত্রা-বিশিষ্ট একটি ট্যাঙ্ক। পাশাপাশি দূষণমুক্ত ট্যাঙ্কেও রাখা হয়েছিল কিছু কাঁকড়াকে। আর তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, এইসকল প্রাণীদের উপর কয়েকদিনের মধ্যেই কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড।
সুমিতের কথায়, এই সমস্যা আঞ্চলিক নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। ফলে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের পরিমাণ কমিয়ে না আনলে এই প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। তবে সুন্দরবন অঞ্চলের কথা বিবেচনা করলে, ম্যানগ্রোভ অরণ্য পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে খানিকটা হলেও অ্যাসিডিফিকেশনকে প্রতিহত করা সম্ভব। পাশাপাশি ট্রলার থেকে নির্গত পেট্রোলিয়াম-জাত বর্জ্য এবং দূষকও সমানভাবে দায়ী এই পরিস্থিতির কারণে। নজর দিতে হবে সে-দিকেও। আগামীদিনে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র, খাদ্যশৃঙ্খল তো বটেই, অর্থনৈতিকভাবেও সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করবে এই পরিস্থিতি, সতর্ক করছেন তিনি। বাঙালির খাদ্যতালিকায় অভাব দেখা দিতে পারে চিংড়ি-কাঁকড়ার মতো মহার্ঘ্য খাবারের। পাশাপাশি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, লাক্ষাদ্বীপ, মালদ্বীপ-সহ প্রবাল প্রাচীর নির্ভর পর্যটনকেন্দ্রগুলিও প্রভাবিত হবে যথেষ্ট। সবমিলিয়ে ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গবেষণা সকলের সামনেই তুলে ধরল ভবিষ্যতের এক অবশ্যম্ভাবী অন্ধকার অধ্যায়। এখন দেখার, এই আগাম সতর্কতার পর, বৈশ্বিক সংগঠনগুলির মধ্যে আদৌ সচেতনতা গড়ে ওঠে কিনা…
Powered by Froala Editor