তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকলেও এতদিন ছিল না কোনো পরীক্ষাগত প্রমাণ। আল্ট্রা-থিন মেটেরিয়ালের মধ্যে সেই অধরা কোয়ান্টাম অবস্থাকেই তৈরি করলেন অল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এই গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেন এক বাঙালি গবেষকও। সদ্য-আবিষ্কৃত এই ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল মায়োরানা জিরো এনার্জি মোড’ কোয়ান্টাম অবস্থার মাধ্যমে খুলে যেতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর নতুন দিগন্ত।
১৯৩০-এর দশকে ইতালিয় পদার্থবিদ ইতোরে মায়োরানা সন্ধান দিয়েছিলেন একটি মৌলিক কণার। তবে অন্যান্য মৌলিক কণাদের থেকে একেবারে ভিন্ন চরিত্রের এই কণাটি। সাধারণত যে কোনো মৌলিক কণারই বিপরীত-ধর্মী প্রতি-কণার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃতিতে। তবে আশ্চর্যের বিষয় মায়োরানা’র প্রস্তাবিত এই কণাটির প্রতি-কণা সেটি নিজেই। তবে এই অদ্ভুত কণার অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র তত্ত্বের মধ্যেই। ল্যাবরেটরি হোক কিংবা মহাবিশ্বে তার উপস্থিতি কখনোই খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিমভাবে এই পদার্থকণা তৈরির পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্পের সন্ধান করে আসছিলেন বিজ্ঞানীরা। লক্ষ্য ছিল বিশেষ অবস্থা তৈরি করে সাধারণ ইলেকট্রনকে মায়োরানা ফার্মিয়নের মতো আচরণ করানো।
“কোনো একটি খুব সরু ধাতব তার, যার শেষ প্রান্তে একটিই মাত্র অণু রয়েছে— এমন একটি সূচাগ্র প্রান্তকে কোনো তলের খুব কাছে আনলে একটা বিশেষ চরিত্র পর্যবেক্ষণ করা যায়। দেখা যায় পদার্থের যে তলের কাছে আনা হয়েছে, সেখানে একটি বিশেষ ভোল্টেজ প্রয়োগ করলে স্পর্শ না করেও তলে উপস্থিত অনুগুলির ইলেকট্রনীয় গঠনের মধ্যে কোয়ান্টাম টানেলিং করা যায়। তবে অতিপরিবাহী এবং ফেরোম্যাগনেটের উপস্থিতি ছাড়া এই পরীক্ষা করা যায় না। এখন স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে প্রতিটি অণুর অবস্থান এবং তাদের শক্তিস্তরের ছবি দেখলে দেখা যাবে সরু ধাতব তারের একেবারে শেষ প্রান্তের অণু দুটিতে তৈরি হয়েছে মায়োরানা ফার্মিয়নের জিরো স্টেট”, গবেষণার আসল উদ্দেশ্যকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলছিলেন গবেষক সোমেশ গঙ্গোপাধ্যায়।
কয়েকবছর আগে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রথম তৈরি করে দেখিয়েছিলেন এই জিরো স্টেট ফার্মিয়নের অস্তিত্ব। দেখিয়েছিলেন ১০টি লোহার অণু দিয়ে গঠিত একমাত্রীয় একটি শৃঙ্খলের শেষপ্রান্তের দুটি অণুতে মায়োরানা ফার্মিয়ন। সেই একই তত্ত্ব অনুযায়ী যদি ফেরোম্যাগনেটের সূক্ষ্ম স্তর দ্বিমাত্রিক তৈরি করা যায় যায় তবে, তার পরিধি ঘিরেও তৈরি হওয়ার কথা মায়োরানা ফার্মিয়নের। এবং দ্বিমাত্রিক তলের পরিপার্শ্বে সৃষ্ট এই মায়োরানা ফার্মিয়ন হিসেব অনুযায়ী হওয়ার কথা একমাত্রার। অল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাই প্রথম সেই কাজটা করে দেখালেন, যা এতদিন অধরা ছিল সকলের কাছেই।
তবে পূর্ববর্তী পদ্ধতির অবলম্বনে নতুন করে এই কণার অস্তিত্ব খোঁজার প্রক্রিয়া শুনতে খুব সহজ মনে হলেও, আদতে একেবারেই তেমনটা নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গাণিতিক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমেই খুঁজে পেতে হয়েছে এই একমাত্রার ফার্মিয়নদের জন্য আদর্শ পরিস্থিতির। সোমেশবাবু জানালেন, “মাত্র ৩০০ মিলিকেলভিন তাপমাত্রায় এই পরীক্ষা করার পর আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়। হিলিয়াম-৩ আইসোটোপের মাধ্যমে এই বিশেষ অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। তাছাড়া ফেরোম্যাগনেট এবং অতিপরিবাহী হিসাবে আমরা ব্যবহার করেছিলাম যথাক্রমে ক্রোমিয়াম ব্রোমাইড ও নিওবিয়াম ডিজেলেনাইড”।
আরও পড়ুন
বাঙালি বিজ্ঞানীর তৈরি নতুন পরিমাপক, ভূমিকম্পের মাত্রা মাপতে রিখটারের দিন শেষ
সোমেশবাবুর বেড়ে ওঠা হাওড়ার শেওড়াফুলিতে। পদার্থবিদ্যায় স্নাতক করেন বেলুড় বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির থেকে। স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন কানপুর আইআইটি থেকে। পরবর্তীকালে মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে পিএইচডি করে বিদেশ সফর পোস্টডকের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু’বছরের পোস্টডকের পর সোমেশবাবু বর্তমানে দ্বিতীয় পোস্টডক করছেন ফিনল্যান্ডের অল্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানেই গবেষণারত তিনি।
পোস্টডক্টরেট গবেষণারত হওয়ার কারণে ল্যাবরেটরিতে চলা মূল পরীক্ষার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। কথায় কথায় উঠে আসে, “বাড়ি থেকে দূরে থেকে পড়াশোনার অভ্যেস কলেজজীবন থেকেই। কিন্তু দেশের বাইরে এই ধরণের গবেষণায় মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করা। একসঙ্গে একই চিন্তাভাবনায় কাজ করতে পারা। সেটাই সম্ভব হয়েছিল বলেই সাফল্য এসেছে গবেষণায়।”
আরও পড়ুন
কালাজ্বরের চিকিৎসায় নতুন ওষুধ, পথ দেখাচ্ছেন বাঙালি বিজ্ঞানীরাই
সম্প্রতি বিশ্বের অন্যতম প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণা। সোমেশবাবু ছাড়াও এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন প্রফেসর কেজিলেবিক, নুরুল হুডা, ভিলিয়াম ভানো, মার্কাস অ্যাপ্রো, অ্যাডাম ফস্টার, পিটার লিলজারথ, তিমু ওজারেন প্রমুখ গবেষকরা।
কিন্তু নতুন করে খুঁজে পাওয়া একমাত্রার এই ফার্মিয়নের বিশেষত্ব কী? পদার্থবিদ্যায় তার গুরুত্বই বা কতটা? সেই প্রশ্নেরও উত্তরের হদিশ দিলেন সোমেশবাবু, “ফার্মিয়নের উপস্থিতি লক্ষ করার জন্য যে এই দ্বিমাত্রিক তল প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেখানে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে একটি তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে সেই তলের প্রান্ত বরাবর। এখন কোনো পদার্থ যদি ওই তলের প্রান্তে রেখে দেওয়া হয়, তবে দেখা যাবে তাতে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হচ্ছে না তরঙ্গের প্রবাহ। পদার্থবিদ্যায় এটিকে ‘টোপোলজিক্যালি প্রটেক্টেড মোড’ বলা হয়। যদি কোনোভাবে অ্যালগরিদম তৈরি করে এই তরঙ্গকে বা কণাগুলিকে ম্যানিপুলেট করা যায়, তবে তা দিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। আমাদের গবেষণার পরবর্তী লক্ষ্যই সেটা সম্ভব করে তোলা।”
আরও পড়ুন
মিশরের যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালি শ্যামলাল, পিরামিডের দেশ নিয়ে লিখলেন প্রথম বাংলা বইও
পদার্থবিদ্যার পরিভাষায় এই শাখাটিকে বলা হয় ‘টোপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং’। তবে গোটা পৃথিবীতে কোথাওই এখনও বিকশিত হয়নি এই শাখা। বাস্তবে বর্তমানে সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটের মাধ্যমে চলে কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনের কাজ। সোমেশবাবুদের গবেষণা অজানা সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর সম্ভাবনাকেই জাগিয়ে তুলছে নতুন করে। বলাই বাহুল্য, টোপোলজিক্যালি প্রটেক্টেড এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি সম্ভব হলে পদার্থবিদ্যায় খুলে যাবে নতুন দিগন্ত। যুগান্তকারী এই পথ তৈরির অন্যতম শরিক হয়ে থাকলেন এক বাঙালি গবেষক। না বললেও চলে, বাংলার কাছে এর থেকে গর্বের আর কিছুই নেই...
Powered by Froala Editor