দেশের প্রান্তিক এলাকায় শক্তির চাহিদা মেটাতেই অভিনব উদ্যোগ। ভেজা কাপড় থেকেই তৈরি করা যাবে বিদ্যুৎ। আইআইটি খড়গপুরের তরুণ গবেষক শঙ্খ শুভ্র দাশ আবিষ্কার করলেন এমনই প্রযুক্তিগত কৌশল। আর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের দৌলতেই গান্ধীয়ান ইয়ং টেকনোলজিক্যাল ইনোভেশন ২০২০-এর জাতীয় সম্মানের পালক জুড়ল তরুণ বিজ্ঞানীর মুকুটে।
তবে মহামারী পরিস্থিতির কারণে এবছর বন্ধ ছিল অনুষ্ঠান। গত ৫ নভেম্বর অনলাইন কনভোকেশনের মাধ্যমেই কৃতী গবেষকদের এই পুরস্কার তুলে দেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ডঃ হর্ষবর্ধন। এই পুরস্কার দুটি বিভাগে দেওয়া হয়ে থাকে। তার মধ্যে প্রযুক্তি বিভাগের অন্তর্গত ‘এসআরএসটিআই’ পুরস্কারে সম্মানিত হলেন খড়গপুরের এই তরুণ গবেষক।
শঙ্খ শুভ্র দাশের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ত্রিপুরার খেদাবাড়ি গ্রামে। তারপর প্রযুক্তিতে স্নাতক এনআইটি আগরতলায়। আসামের এনআইটি শিলচরে করেছেন স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। ২০১৫ সালে আইআইটি খড়গপুরে গবেষণার কাজে যুক্ত হন।
প্রান্তিক জেলায় বাড়ি হওয়ার কারণে ছোটোবেলা থেকেই হাত ধরেছিল বিভিন্ন প্রতিকূলতা। বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে যেত হত বহু দূরের শহরের স্কুলে। টিউশনও সেভাবেই। এক প্রকার কষ্ট আর যুদ্ধ করেই চালিয়ে যেতে হতে শিক্ষাগ্রহণ। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তাই আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই থাকত সংসারে। কাজেই পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ার সময় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর্থিক সঙ্গতি।
প্রান্তিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা বলেই, শক্তির চাহিদাকে সামনে থেকে দেখেছিলেন গবেষক শঙ্খ শুভ্র দাস। আর সেই কারণেই হয়তো তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে এনার্জি জেনারেশন। প্রত্যন্ত এলাকাতেও কম খরচে শক্তি পৌঁছে দেওয়াই ছিল গবেষণার মূল লক্ষ্য। সেখান থেকেই এসেছিল এই ভাবনা। কিন্তু কীভাবে তার সমাধান খুঁজেছেন তিনি?
আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় শান্তি পুরস্কার পেলেন অমর্ত্য সেন
“আমাদের ব্যবহৃত কাপড় সাধারণত তৈরি হয় ফ্যাব্রিক দিয়ে। আর তার মধ্যে অসংখ্য কৈশিক নালিপথ থাকে। প্রযুক্তির পরিভাষায় যেগুলোকে চ্যানেল বলি আমরা। আমরা নির্দিষ্ট আকারের কাপড়ের একটি খণ্ডের এক প্রান্ত তড়িৎবিশ্লেষ্য দ্রবণ অর্থাৎ নুন-জলে চুবিয়ে রাখতাম। আর নিম্ন প্রান্ত খোলা থাকত হাওয়ায়। পৃষ্ঠটানের কারণে নুন-জল থেকে তড়িৎ আধান ওই সূক্ষ্ম নালিপথগুলির মধ্যে দিয়েই উপরে উঠতে থাকে। যার কারণে কাপড়ের দুই প্রান্তের মধ্যে মেরুকরণের সৃষ্টি হয়। এবং এই তড়িৎ-মেরুকরণের জন্যই তৈরি হয় বিভব পার্থক্য”, জানালেন গবেষক শঙ্খ শুভ্র দাশ।
কিন্তু নুন-জল দিয়ে বিভবপার্থক্য তৈরি করাই সমাধান নয় শক্তি সমস্যার। বরং দরকার সেই শক্তিকে সঞ্চয় করার। সেই উপায়ও বিশদে বললেন তরুণ গবেষক, “আসলে এই বিভব পার্থক্যটা মুক্ত বর্তনীর বিভব। ফলে ব্যবহারযোগ্য নয়। আমরা এটাকে একটি রোধের ব্যবহারে আমাদের তৈরি যন্ত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় প্রথমে। তারপর ব্যাটারির মাধ্যমে সঞ্চয় করা হয় সেই শক্তি।”
আরও পড়ুন
কোনো ব্যক্তি নন, এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতল এই সংস্থা
এক্ষেত্রে উৎপাদিত বিভব পার্থক্যের পরিমাণ থাকে মাত্র ৭০০ মিলি ভোল্টের মতো। তবে এই উৎসকে বেশ কয়েকবার শ্রেণী এবং সমান্তরাল সমন্বয়ের মাধ্যমেই বাড়ানো হয় ১২-১৪ ভোল্ট পর্যন্ত। ফলে অনায়াসেই তা দিয়ে শক্তির চাহিদা মেটা যায় ঘরোয়া বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের। ফোন চার্জ দেওয়া থেকে শুরু করে, এলইডি বাল্ব, সবই চলতে পারে এই যন্ত্রের মাধ্যমেই।
শঙ্খবাবু জানান, খড়গপুরের প্রত্যন্ত একটি গ্রামের ধোবীঘাটে গিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছিলেন এই যন্ত্র। আর সেখানেই নিশ্চিত হয়ে যায় যন্ত্রের কার্যকারিতার সাফল্যও। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যন্ত্রের খরচও থাকছে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যেই। বাজারে এলে আনুমানিক দামও থাকবে মাত্র ১০০ টাকা।
আরও পড়ুন
সেবার নোবেলের দাবিদার মহাত্মাও; তাঁর মৃত্যুতে বাতিল হল নোবেল শান্তি পুরস্কারই
তবে এখানেই শেষ নয়। এই যন্ত্র ছাড়াও শক্তি উৎপাদনে আরও একটি গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শঙ্খ শুভ্র দাশ। কৈশিন নলের মধ্যে দিয়েই তরলের প্রবাহের কারণেও তৈরি হয় বিভব প্রভেদ। আর তা দিয়েই হতে পারে সেলফ-চার্জিং ডিভাইস। কাপড়ের মতোই একই ভাবে ফিল্টার পেপারের ব্যবহারে সেই যন্ত্রও তৈরি করেছেন তরুণ গবেষক। তবে কাগজের ব্যবহারে ৮-১০ দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে কমতে থাকে যন্ত্রের কার্যকারিতা। এখন তা নিয়েই চলছে গবেষণা। বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এই যন্ত্রের কার্যকারিতা। সফলতা মিললে খুলে যেতে পারে নতুন এক দিগন্ত। কারণ এই সেলফ-চার্জিং ডিভাইস দিয়েই সমস্ত চিকিৎসার যন্ত্রাদি চালানো যাবে প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে। বিদ্যুতের স্থায়ী সরবরাহ না থাকলেও অনায়াসেই করা যাবে অস্ত্রোপচারের কাজ। প্রযুক্তি জগতে সেই বিপ্লব আনার লক্ষ্যেই এখন লড়াই করে যাচ্ছেন ত্রিপুরার বিজ্ঞানী শঙ্খ শুভ্র দাশ। আর ছোটোবেলায় বেড়া ওঠা সেই প্রান্তিক গ্রামই যেন উদ্যম যুগিয়ে যাচ্ছে তাঁকে...
Powered by Froala Editor