ইলেকট্রনের ভর কত— তা সকলেই আমরা পড়েছি দশম শ্রেণীর পাঠক্রমে। তবে সেই ভর ইলেকট্রনের স্থিতিশীল ভর। আদতে ধাতু কিংবা অধাতুর ক্ষেত্রে বন্ধনশক্তির ওপর নির্ভর করে সামান্য হেরফের হয় ইলেকট্রনের ভরে। পদার্থবিদ্যার পরিভাষায় যাকে বলা হয় কার্যকরী ভর। ১৯৭৫ সালের কথা। প্রথমবার পদার্থবিদদের চোখে ধরা পড়ে ইলেকট্রনের একটি বিশেষ চরিত্র। কেবলমাত্র বিরল মৃত্তিকা মৌল (Rare Earth Metals) অর্থাৎ ল্যানথানাইড এবং অ্যাকটিনাইডের যৌগে ইলেকট্রনের কার্যকর ভর হয় স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় হাজার গুণ। গবেষকরা এই বিশেষ ইলেকট্রনের নামকরণ করেন ‘হেভি ফার্মিয়ন’ (Heavy Fermions) নামে। এবার প্রথমবারের জন্য ল্যাবরেটরিতে সাধারণ ধাতুর কৃত্রিম যৌগে প্রস্তুত করা হল এই ধরণের বিশেষ কণা। যার নেপথ্যে রয়েছেন এক বঙ্গসন্তান।
ট্যানটালাম ডাই সালফাইড। এই বিশেষ যৌগটিকেই এই গবেষণার কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা চলে। তবে এই আবিষ্কার খানিকটা আকস্মিকভাবেই। ২০২১ সালের শুরুর দিক সেটা। খানিকটা হলেও শিথিল হয়েছে লকডাউন। “ল্যাবরেটরিতে যৌগটি পর্যবেক্ষণের সময় যন্ত্রে হঠাৎ করেই ধরা পড়ে উচ্চ কার্যকরী ভর-সম্পন্ন ইলেকট্রনের অস্তিত্ব। প্রাথমিকভাবে যার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাইনি আমরা”, বলছিলেন অল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সোমেশ গঙ্গোপাধ্যায়। এই অদ্ভুত ঘটনা নজরে আসার পরেই শুরু হয় রহস্যের অনুসন্ধান।
সাধারণভাবে, দুটি অবস্থায় প্রকৃতিতে পাওয়া যায় ট্যানটালাম ডাই সালফাইডকে— দ্বিমাত্রিক ধাতু এবং কোয়ান্টাম স্পিন তরল হিসাবে। একের পর এক তত্ত্ব ব্যর্থ হওয়ার পর, রহস্যের যবনিকা পতন করে ল্যাবরেটরি প্রস্তত করা ট্যানটালাম ডাই সালফাইডের আণবিক গঠন। হ্যাঁ, এই বিশেষ যৌগের আণবিক সজ্জাই দায়ী ভারি ইলেকট্রন বা ‘হেভি ফার্মিয়ন’-এর অস্তিত্বের জন্য।
আরও পড়ুন
৫০টির বেশি ব্যাঙের প্রজাতি আবিষ্কার, ভারতীয় বিজ্ঞানীকে বিশেষ সম্মাননা
“ট্যানটালাম ডাই সালফাইডের খুব পাতলা, দ্বিস্তরীয় আস্তরণ নিয়ে মূলত কাজ করছিলাম আমরা। পারমাণবিক স্তরে বিশ্লেষণ করার পর নজরে আসে সেখানে ভুলবশত একইসঙ্গে দ্বিমাত্রিক ধাতু এবং কোয়ান্টাম স্পিন তরল— দুটি অবস্থাই তৈরি হয়েছিল। আর এই দুই পৃথক দশা বা অবস্থার উপরিপাতের কারণেই তৈরি হয়েছে হেভি ফার্মিয়ন”, জানালেন সোমেশ।
আরও পড়ুন
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় বাঙালি ডাক্তার উজ্জ্বল পোদ্দার
আরও পড়ুন
৬৪ ফোঁটা রক্ত থেকেই পাকড়াও খুনি, নেপথ্যে বাঙালি বিজ্ঞানী
তবে তখনও পর্যন্ত সবটাই ছিল বিচ্ছিন্ন একটি পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে গবেষকদের অনুমান। পরবর্তীতে কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরি ট্যানটালাম ডাইসালফাইডের দ্বিস্তরীয় চাদর তৈরি করেন গবেষকরা। কোয়ান্টাম ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে সেই চাদরের মধ্যে একইসঙ্গে প্রতিস্থাপিত করা হয় দুটি পৃথক দশা। আর এই পরীক্ষার ফলাফলই চূড়ান্ত শিলমোহর বসায় তাঁদের অনুমানে।
তবে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম ভারী ফার্মিয়ন তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই এই গবেষণা। বরং, আগামী দিনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে পদার্থবিদ্যায়। টোপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং অপ্রচলিত অতিপরিবাহিতার ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে চলেছে এই গবেষণা।
বাঙালি গবেষকের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে বিজ্ঞানের জগতে। সম্প্রতি, বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্রিকা নেচারে প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণাপত্র।
বর্তমানে কর্মসূত্রে ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি শহর তাঁর আস্তানা হলেও, সোমেশের বড়ো হয়ে ওঠা হুগলিতে। বেলুড় বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির থেকে স্নাতকতা ও কানপুর আইআইটি থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করেন সোমেশ। পরবর্তীতে মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে পিএইচডি করার পর পোস্টডক্টরেটের জন্য বিদেশ সফর। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়েও দু’বছর গবেষণা করেছেন তিনি। গত বছরেও টোপোলজিক্যাল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার তথা গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। এবার আরও একবার পদার্থবিদ্যার জগতে নতুন রহস্যোন্মোচন করলেন শেওড়াফুলির বঙ্গসন্তান।
Powered by Froala Editor