বাংলা ভাষা আন্দোলন অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। শুধু বাংলাদেশই নন, অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করে এসেছেন তরুণ বয়স থেকেই। গুপ্তচরের কাজ করেছেন নেতাজি এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে। চলে গেলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী আলি তাহের মজুমদার। নেতাজির জন্মদিনেই পাড়ি দিলেন অনন্তের দিকে। বাংলাদেশের কুমিল্লার সদর দক্ষিণের চাঁদপুরে নিজের বাড়িতে এদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর।
১৯১৭ সালে কুমিল্লায় চাঁদপুরে জন্ম আলি তাহেরের। ছাত্রাবস্থা থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৯৩৫ সাল। গান্ধীজির মতাদর্শে অনুপ্রাণীত হয়েই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সক্রিয় কংগ্রেসী রাজনীতিতে। স্বদেশি আন্দোলন তো বটেই, ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন কুমিল্লার ভূমিপুত্র।
তবে বেশিদিন আন্দোলনের সৈনিক হয়ে থাকা গেল না। বিশ্বযুদ্ধের আবহ। ধসে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। পরিবারের ভার টানতে বাধ্য হয়েই তিনি যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। পাঞ্জাব ৮ম ইউনিটের হয়ে তাঁর পোস্টিং হল কলকাতায়। তবে মাথার ওপর যে ইংরেজ রাজ। যাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধেই তিনি চালিয়ে এসেছেন যুদ্ধ। তবুও খিদের কাছে, উপার্জনের কাছে অপারগ হয়েই বেছে নেওয়া এই পথ।
সেনা-প্রশিক্ষণের পর ১৯৪৩ সালের শুরুতে ছুটিতে কুমিল্লায় ফেরেন তিনি। তবে মনস্থির করে নেন, আর ফেরত যাবেন না সেনাবাহিনীতে। অন্যদিকে তাঁর অনুপস্থিতিতে জারি হল গ্রেপ্তারি পরওয়ানা। সেই সময় তাঁর মতোই প্রায় বাধ্য হয়েই কুমিল্লায় পুলিশের খাতায় নাম তুলেছেন আব্দুল মজিদ। তিনি তখন পুলিশের ডিসি পদে। ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে আল তাহেরকে বাঁচাতে, তাঁর নামে মিথ্যে রিপোর্ট তৈরি করেন তিনি। পাঞ্জাবে লিখিত চিঠি পাঠান, জাপানি বোমায় নিহত হয়েছেন আলি তাহের।
আরও পড়ুন
পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন বিপ্লবী উধম সিং
দেশের স্বাধীনতায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার আরও একটা সুযোগ যেন চলে আসে হাতের মুঠোয়। ১৯৪৩ সালেই তিনি যোগ দেন নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীতে। আমেরিকার বোমা প্রস্তুতকারী সংস্থা স্কোয়াড্রন কোম্পানিতে কাজ নেন তিনি। সেখানে থেকেই চালিয়ে যান অনুচরবৃত্তি। নেতাজির অন্তর্ধানের পরই সেই কাজ ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন কুমিল্লায়।
১৯৪৬ সালে এক চায়ের দোকানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় আরেক তরুণ নেতার। শেখ মুজিবর রহমান। ছাত্রদের নিয়েই বাংলা ভাষা-ভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তখনও তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেননি। আলি তাহের হাত মেলালেন তাঁর সঙ্গে। শুরু হল ভাষাকে সামনে রেখে স্বাধীনতার এক নতুন অধ্যায়। দেশভাগের সময় শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দি প্রমুখের সঙ্গেই আপ্রাণ লড়াই চালিয়েছেন তিনি ভাষার জন্য।
আরও পড়ুন
তর্কযুদ্ধে নেমেছিলেন খোদ টলস্টয়ের বিপক্ষে, বিস্মৃতির অতলে বিপ্লবী তারকনাথ দাস
তবে স্বাধীনতা মিললেও যেন স্বাধীন হল না ‘বঙ্গদেশ’। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে অস্বীকার করে পাকিস্তান সরকার। ফলে দিন দিন আরও জোর বাড়তে থাকে প্রতিবাদের। আওয়ামী লিগের হয়ে একের পর এক আন্দোলনে অংশ নেন তিনি। একাধিকবার বন্দি হয়েছেন পাকিস্তানি প্রশাসনের হাতে। ১৯৫৬ সালে তাঁকে টানা ৩ বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে পুলিশ। তবুও আটকে রাখা যায়নি তাঁর প্রতিবাদী সত্তাকে। ছাড়া পেয়ে আবার যোগ দেন আন্দোলনে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পিছনেও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ সেই লড়াই শেষ হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর।
তবে স্বাধীনতার পর তাঁকে মনে রাখেনি কোনো বাংলাই। ভাষা দিবস আর অন্যান্য আঞ্চলিক অনুষ্ঠানে সাময়িক আমন্ত্রণের পরই যেন ভুলে যাওয়া হত তাঁকে। দারিদ্র আর অনটন নিয়েই দীর্ঘজীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। সেই ক্ষেদ নিয়েই নীরবেই যেন চলে যাওয়া তাঁর। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ— তাঁর মৃত্যুতে মুছে গেল জীবন্ত ইতিহাসের একটি অধ্যায়...
আরও পড়ুন
ক্ষুদিরামকে নিয়ে সিনেমা, তথ্যের যোগান দিলেন বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের বিপ্লবী ভাইয়েরা
Powered by Froala Editor