১৯৯৪ সালের এক সকাল। আমেরিকার ন্যাশনাল ফুটবল লিগের প্রাক্তন তারকা খেলোয়াড় ওজে সিম্পসনের বাড়িতে এসে অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়া পাচ্ছেন না পরিচারিকারা। শেষ পর্যন্ত খবর গেল পুলিশের কাছে। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করলেন শ্রীমতি সিম্পসনের (Miss Simpson) মৃতদেহ। সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু, রোনাল্ড গোল্ডম্যান। দুজনকেই কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। এদিকে ওজে সিম্পসন তখন নিরুদ্দেশ।
গোটা আমেরিকাজুড়ে চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছিল এই জোড়া খুনের রহস্য। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ কিছুই নেই। আছে কেবল ৬৪ ফোঁটা রক্ত। মাত্র ৬৪ ফোঁটা রক্তের নমুনা থেকেই খুনিকে শনাক্ত করার মতো কঠিন কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রণজিৎ চক্রবর্তী (Ranajit Chakraborty)। মৃতের রক্তের মধ্যেও যে খুনির ডিএনএ নমুনা লুকিয়ে থাকে, তা আগেই প্রমাণ করেছেন তিনি। এবার সেই তত্ত্বকেই প্রমাণ করার পালা।
১৯৪৬ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে বরানগরে জন্ম রণজিৎ চক্রবর্তীর। ছোটো থেকেই রহস্যের প্রতি নেশা ছিল তাঁর। আর সেই রহস্যের টানেই পরিসংখ্যান তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। সংখ্যার চেয়ে রহস্যময় যে আর কিছুই হয় না। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা। এই সময় শিক্ষক এবং গাইড হিসাবে পেয়েছেন বিখ্যাত গাণিতিক পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ সিআর রাওকে। তবে শেষ পর্যন্ত গাণিতিক পরিসংখ্যানের চেয়েও জৈব-পরিসংখ্যানই বেশি আকর্ষণ করেছিল তাঁকে।
ইতিমধ্যে ১৯৬৬ সালে মার্শাল নিরেনবার্গ এবং হরগোবিন্দ খোরানা আবিষ্কার করে ফেলেছেন ডিএনএ সংকেত পাঠোদ্ধারের পদ্ধতি। জৈব-পরিসংখ্যানের জগতে যেন বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল এই আবিষ্কার। ভারতে বসে এই পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে শুরু করেছেন রণজিৎ। একের পর এক প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে দেশের সামগ্রিক জিনপুলকে বোঝার কাজে ব্যবহার করা যায় এই পদ্ধতিকে। এমনকি অসংখ্য জিনঘটিত রোগের মোকাবিলাতেও কাজে লাগানো যায় এই পদ্ধতি। একসময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমাতে নয়া প্রযুক্তি, জড়িয়ে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী
১৯৭৩ সালে টেক্সাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হয়ে আমেরিকা পাড়ি দিলেন রণজিৎ। সেখানে গবেষণার পরিকাঠামো আরও উন্নত। ফলে আরও জোরকদমে শুরু হল কাজ। রণজিৎ চক্রবর্তীর গবেষণার সবচেয়ে বড়ো পরিসরটি হল, একটি জৈব নমুনা থেকে ঠিক কী কী তথ্য সংগ্রহ করা যায়, তার তালিকা তৈরি করা। অনেক সময় দেখা যায়, একই মানুষের শরীরে নানা অংশ থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ নমুনাগুলির মধ্যেও কিছু পার্থক্য রয়েছে। ঠিক কতটা পার্থক্য থাকলে দুটি ডিএনএ নমুনাকে একই ব্যক্তির বলে ঘোষণা করা যায়, আর কী কী মিল থাকলেও তা আলাদা ব্যক্তির নমুনা হতে পারে – তা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
বাংলার 'প্রথম' চলচ্চিত্র সমালোচক তিনি, চিদানন্দ দাশগুপ্তকে কতটা মনে রেখেছে বাঙালি?
এছাড়া তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল মহামারীর ইতিহাস নিয়ে। বলা ভালো, জিন থেকে কীভাবে সেই ইতিহাসের পাঠোদ্ধার সম্ভব, তা নিয়ে। লিখিত ইতিহাসের অজান্তেই এক-একটি জাতি নানারকম রোগজীবাণুর সংস্পর্শে এসেছে। তাদের শরীরে সেই রোগের অনাক্রমতাও তৈরি হয়েছে। পরবর্তী মহামারীর মোকাবিলার সময় এইসমস্ত তথ্য হাতে না থাকলে অনেকটাই অসুবিধা হয়। জিনগত নমুনা থেকে সেই তথ্য খুঁজে বের করেছিলেন রণজিৎ।
আরও পড়ুন
বাংলার নবম গ্র্যান্ড মাস্টার মিত্রাভ, আর কোন কোন বাঙালি রয়েছেন এই তালিকায়?
গবেষণার পাশাপাশি দীর্ঘদিন মার্কিন পুলিশের ফরেনসিক বিভাগেও কাজ করেছেন তিনি। ওজে সিম্পসনের মামলাটি ছাড়াও অসংখ্য মামলায় সাহায্য করেছেন পুলিশ বিভাগকে। তার স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৯৮ সালে এফবিআই-এর তরফ থেকে পেয়েছেন পুরস্কারও। ফরেনসিক স্ট্যাটিসটিক্সে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল তাঁর আবিষ্কারগুলি। ২০০২ সালে এফবিআই-এর ফরেনসিক অ্যাকাডেমিতেও যোগ দিয়েছিলেন। সারা জীবনে ৬০০-র বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন তিনি। আজও সেগুলি নানা গবেষণায় প্রামাণ্য নথি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ২০১৮ সালে ৭২ বছর বয়সে টেক্সাস শহরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রণজিৎ চক্রবর্তী। তবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আবিষ্কারের মতোই তাঁর ডিএনএ শনাক্তকরণ পদ্ধতিও যে ক্রমশ মাইলস্টোনে পরিণত হবে, সেটা বলাই যায়।
Powered by Froala Editor